সুধারণার মতো মনের প্রশান্তি কখনও কিছু নেই। প্রকৃত অক্ষম সেই, যে নিজেকে পরিচালনায় ব্যর্থ। যার আখলাক-চরিত্র মন্দ, সে নিজেকেই নিজে শাস্তি দেয়। আর আল্লাহর ভাগ্যলিপির অদ্ভুত একদিক হলো- জ্ঞানী ব্যক্তি সতর্কতা সত্ত্বেও হোঁচট খায়। সীমালঙ্ঘন করেও অজ্ঞ ব্যক্তি বেঁচে যায়। পূর্ণতর প্রজ্ঞা আর কার্যকর ইচ্ছাশক্তি তো আল্লাহরই। অতএব, হে আল্লাহর বান্দা, সর্বাবস্থায় ভালো করা ও ভালো হওয়ার চেষ্টা করুন। যদিও আপনি মানুষের কাছে ভালো ব্যবহার না পেয়ে থাকেন। কারণ সদ্ব্যবহার ভালোবাসার দিকে নিয়ে যায়। বিরোধ শত্রুতার পথে টেনে নেয়। সত্যবাদিতা আস্থা জাগায় আর মিথ্যাবাদিতা অবিশ্বাসযোগ্য বানায়। ‘সমান নয় ভালো ও মন্দ। জবাবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ চরিত্র তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয়, যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান।’ (সূরা ফুসসিলাত : ৩৪-৩৫)।
মুসলিম ভাইয়েরা, এভাবেই আল্লাহর রীতি চলমান প্রাণ ও প্রাণীদের মাঝে চলমান। অনেক নেয়ামত আছে যে ব্যাপারে ভোগকারীরা উদাসীন। ওই নেয়ামতের মধ্যে থেকে তারা সেটা অনুভবই করে না যাবৎ সংকটে পড়ে। তাদের ওপর আসে দুর্ঘটনা। তখনই শুধু তারা দেখতে পায় আল্লাহর দান-নেয়ামত। এতদিন এসব ছিল তাদের চোখের সামনেই, অথচ তারা ছিল উদাসীন।
আল্লাহর বান্দারা, ব্যাপারটি যখন এমনই, তাহলে একটু ভেবে দেখুন, মুসলিমদের কথাÑ যখন আল্লাহ তাদের প্রতি অনুগ্রহ করলেন মসজিদগুলো আবার খুলে দেওয়া এবং জুমা ও জামাত আদায়ের সুযোগ দিয়ে। অনুধাবন করুন তো এই মহামারি তাদের আঘাত করার পর আবার মসজিদ উন্মুক্ত হলে কীভাবে তাদের মাঝে ফুটে উঠেছিল খুশি, আনন্দ ও প্রফুল্লতা। দয়াময় দাতা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিÑ তিনি যেন দ্রুত একে নির্মূল করে দেন। একে উঠিয়ে নিয়ে কৃপা ও করুণাধন্য করেন। নিশ্চয়ই তিনি মহাশ্রোতা ও সাড়াদাতা।
তারা ফিরে এসেছে সালাতের মিহরাবে; জান্নাতি বাগানে। বলা হয়ে থাকেÑ যে বাধার দংশনের স্বাদ চেখেছে, তার জন্য ভালোবাসার সবচেয়ে সঠিক অনুভূতি সততা। সবচেয়ে সুস্বাদু সুস্থতা সেটাই যা অসুস্থতার পর আসে। আর সেরা অনুভূতি হলো কাছে থাকতেও প্রিয়তমের দূরত্ব।
প্রিয়জনরা, মসজিদগুলো যদি তার আবাদকারীর অনুপস্থিতির বৃত্তান্ত বর্ণনা করে, বলবে অজুকারী, পবিত্রতা অর্জনকারী, প্রভাতে আগমনকারী, অন্ধকারে হেঁটে আগমনকারী, প্রথম কাতারে প্রতিযোগী, রুকু-সিজদায় নিরত, তেলাওয়াত ও জিকিরে মশগুলদের কথা। যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছেÑ ‘এমন লোকেরা, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিগুলো উল্টে যাবে।’ (সূরা নূর : ৩৭)।
যেসব লোকের অন্তর পড়ে থাকে মসজিদে। এর খুঁটিগুলোর মাঝে তাদের চিত্ত হয় সুখী। এর মেঝেতে বসলে তাদের হৃদয় হয় প্রশান্ত। মসজিদে বারবার আসায় তারা ক্লান্ত বা বিরক্ত হয় না। বাসা থেকে মসজিদের দূরত্ব বেশি হলে প্রতিটি কদমে নেকির আশা করে। একইভাবে সওয়াবের আশা করে মসজিদে আসার প্রতীক্ষায়, আগেভাগে আসার প্রতিযোগিতায় এবং জিকির ও তাকবিরে মজে থাকায়। এরাই সেই সাত শ্রেণির লোকের অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ নিজের ছায়ায় স্থান দেবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। মসজিদের সঙ্গে অন্তর ঝুলে থাকা ব্যক্তিরা।
ইবনে রজব (রহ.) বলেনÑ ‘মসজিদের সঙ্গে ঝুলে থাকে তাদের অন্তর’ কিংবা অন্য বর্ণনা অনুযায়ী, ‘ঝুলে থাকে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর ফিরে না আসা পর্যন্ত’ অর্থাৎÑ সে মসজিদকে ভালোবাসে এবং তাতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঘনিষ্ঠতা বোধ করে। এমনকি যখন সে মসজিদ থেকে বের হয়, ফিরে না পর্যন্ত তার সঙ্গে মন ঝুলে থাকে।’ তিনি আরও বলেনÑ ‘এ অবস্থা তারই অর্জন হয় যে নিজের নফসের নিয়ন্ত্রক হতে পারে এবং একে টেনে নেয় আল্লাহর আনুগত্যে। এমনকি তা হয়ে ওঠে আল্লাহর অনুগত। কেননা প্রবৃত্তি প্রিয়তমের স্থানকেও ভালোবাসার পথে ডাকে। আর ইবাদতের ভূমিকে ভালোবাসতে ওই অন্তরই উদ্বুদ্ধ হয় যা তার মাওলাকে ভালোবাসে। প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে। মসজিদ যার চোখের শীতলতা। অন্তরের আরোগ্য এবং বক্ষের বন্ধু।’
প্রিয় সুধী, আমাদের রবের প্রতি সুধারণাÑ এ মহামারি এসে মুসলিমদের মসজিদ গমনে অন্তরায় হয়েছিল। অনুমান করি তাদের অন্তরগুলো তখন মসজিদের সঙ্গে ঝুলেছিল। তাদের মধ্যে ছিল তীব্র আকাক্সক্ষা আর অদম্য আগ্রহ। আল্লাহর বান্দারা, এটাই তো মসজিদের ভালোবাসা। আল্লাহর ঘরের মুহাব্বত। মোমিন তো তাই পছন্দ করে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল পছন্দ করেন। তাই অপছন্দ করে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অপছন্দ করেন। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘মসজিদের ভালোবাসা সাব্যস্ত হয় জামায়াতের পাবন্দি ও জামায়াতের সঙ্গে নামাজ সংরক্ষণের মাধ্যমে।’
এখানে একটি সূক্ষ্ম তাৎপর্য হলোÑ আলেমরা বলেন, নবীজির (সা.) উক্তি ‘মসজিদের সঙ্গে মুআল্লাক বা ঝুলে থাকে’Ñ এই ‘তাআল্লুক’ শব্দটি ‘উলাকা’ শব্দ থেকে নির্গত। এর অর্থ তীব্র ভালোবাসা। সুতরাং অন্তর মসজিদের সঙ্গে মুআল্লাক মানে অন্তর মসজিদকে এবং মসজিদের জামায়াতে শামিল হওয়াকে তীব্রভাবে কামনা করে। বেশভুষায়, হাঁটাচলায়, ব্যবস্থাপনায় ও শৃঙ্খলায় মসজিদের গাম্ভীর্য ও মর্যাদা বজায় রাখে। আর কেউ যতক্ষণ সালাতের অপেক্ষায় থাকে সে ততক্ষণ সালাতেই থাকে। কেউ সালাতের অপেক্ষায় থাকলে সে যেন সালাতেই লিপ্ত থাকে। যতক্ষণ সালাত তাকে আটকে রাখে সে ততক্ষণ সালাতেই থাকে। আর যতক্ষণ নামাজের স্থান ত্যাগ না করে ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকেনÑ ‘হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন। তার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন। নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয় বর্ণনা করব, যেটি তোমাদের গুনাহ মার্জনা করবে এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবে? সাহাবায়ে-কেরাম বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! হ্যাঁ। তিনি বললেন, কষ্টকর হলেও পরিপূর্ণভাবে অজু করা; অধিক কদম দিয়ে মসজিদে যাওয়া এবং এক ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পর পরবর্তী নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। এটিই ‘রাবাত’, এটিই ‘রাবাত’। অর্থাৎ দেশের সীমানা পাহারা দেওয়ার সমতুল্য।’
এসব লোকের অন্তর ঝুলে থাকে মসজিদের সঙ্গে। পক্ষান্তরে কিছু লোকের অন্তর পড়ে থাকে বাজারে-মার্কেটে। ঝুলে থাকে আধুনিক মনিটর, যোগাযোগের মাধ্যম ও চ্যানেলে। অতএব, পবিত্র সেই সত্তা, যিনি এই অন্তর ও ওই অন্তরগুলোর মাঝে ব্যবধান গড়ে দিয়েছেন। কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘মোমিন ব্যক্তিকে তিন স্থানে দেখতে পাওয়া শোভনীয় : মসজিদ আবাদ করায়, গৃহের ছায়ায় এবং বৈধ কোনো প্রয়োজনে।’
মসজিদে বসা ব্যক্তির তিনটি ভূমিকা। যেমনÑ বর্ণিত হয়েছে মুসনাদ আহমাদে : ‘উপকারী ভাই কিংবা প্রজ্ঞাবাক্য (বিতরণ-আহরণ) বা রহমতের অপেক্ষা।’
অভিনন্দন এরপর অভিনন্দন ওই ব্যক্তির জন্য, যিনি এই সুন্দর গুণগুলো অর্জন করেছেন। যাকে আল্লাহ তায়ালা নবীজির (সা.) মুখে সম্মানিত বিশেষণে ধন্য করেছেন। নবীজি (সা.) এরশাদ করেন, ‘অন্ধকারে মসজিদে গমনকারীদের কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ দাও। ‘যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল মসজিদে গমনাগমন করবে, প্রতিবার গমনাগমনের বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে মেহমানদারির ব্যবস্থা করবেন।’ (বোখারি ও মুসলিম)
আল্লাহর বান্দারা, এসব আনন্দ আর খোশ-খবর ছাড়াও আল্লাহর ঘরে আগমনকারী পুণ্যবানরা যা অর্জন করেন, তা হলোÑ আল্লাহর ঘরে ফিরে এলে, তাঁর বাগানে নামাজ পড়লে, তাঁর সন্তুষ্টিতে অগ্রগামী হলে আল্লাহর আনন্দের জোয়ার বয়। যেমন হাদিসে এসেছেÑ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে মুসলিম ব্যক্তি নামাজ ও জিকির-আজকারের জন্য মসজিদকে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নেয়, আল্লাহ তার আগমনে অত্যধিক খুশি হন। যেমন হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তি ফিরে এলে আপনজনেরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।’ (ইবনে আবি শাইবা, ইবনে মাজা, ইবনে খুজাইমা ও ইবনে হিব্বান)।
আল্লাহর বান্দারা, এরপর আছে ফেরেশতাদের অভ্যর্থনা। কিছু ফেরেশতা ফজর ও আসর সালাতে হাজির হন। কিছু ফেরেশতা জান্নাতের বাগান ও জিকিরের মজলিসগুলোতে উপস্থিত হন। আরও কিছু ফেরেশতা নামাজের স্থানে বসে আল্লাহর জিকিরকারীদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করতে থাকেন।
৫ জিলকদ ১৪৪১ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত
ভাষান্তর- আলী হাসান তৈয়ব