
প্রকাশ: ০১:৪০:১২ AM, রবিবার, মে ২৭, ২০১৮ | |
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে কথা। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়, কুশল বিনিময়, আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ কিংবা আড্ডা সবখানেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে ‘কথা’। আবার যে-কোনো সম্পর্ক সহজ কিংবা কঠিন হওয়াও নির্ভর করে সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের কথোপকথনের ওপর।
কথার খোঁচা : হাসিব (ছদ্মনাম) পড়াশোনা করছে একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। খেলাধুলায় পারদর্শী হলেও পড়াশোনা আয়ত্ত করতে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই সময় লাগে হাসিবের। তাই তাকে বেশকিছুটা সময় কাটাতে হয় লাইব্রেরিতে। এ নিয়ে সহপাঠীদের মধ্যে হাসাহাসির অন্ত নেই। ‘তুই তো সব পড়ে ফাটায়ে ফেলছিস দোস্ত’ এ ধরনের কথা শুনতে হয় প্রতিনিয়ত। পরীক্ষা খারাপ দিলেও কাউকে বলার উপায় নেই। এভাবে দিন দিন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে হাসিব।
অপরদিকে, যারা হাসিবকে এসব বলে, তারা নিজেরাও অনেক কিছু আড়াল করে, যেন কেউ তাকে খোঁচাতে না পারে। অন্যকে বলতে ভালো লাগলেও ওই একই কথা নিজের শুনতে খারাপ লাগে তাদের।
যে-কোনো পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করা : রেবেকা একজন গৃহিণী। শিক্ষাজীবন যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে শেষ করা সত্ত্বেও পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় পরিবার, সন্তান আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে চাকরি করার কথা আর ভাবলেন না। সবটুকু মনোযোগ ঢেলে দিলেন সংসারে। গোছানো-পরিপাটি সংসার নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু বাধ সাধল আশপাশের মানুষ। ‘আহা রে এত পড়ালেখা করে শেষপর্যন্ত এই!’ কিংবা, ‘অমুক তো চাকরি করে, তুমি কর না কেন’ এ জাতীয় কথা শুনতে শুনতে একসময় হতাশায় ভুগতে থাকে রেবেকা। অনেক ভেবে নেওয়া সিদ্ধান্তকে ভুল মনে হয়। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়তে থাকে ভীষণভাবে।
ঠিক বিপরীত সমস্যা নাজিয়ার। সকাল-সন্ধ্যা অফিস সেরে বাসায় ফিরে রান্নাবান্না, সন্তানদের দেখাশোনা, বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগদান ইত্যাদি করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। তবু কথার শেষ নেই। ‘মেয়েরা চাকরি করলে সংসারের এ-ই হাল হয়’ টিপ্পনী কেটে বলে অনেকেই।
পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারে না বলে এমনিতেই এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগে, তার ওপর এসব কথার বাণে জর্জরিত হতে থাকে প্রতিনিয়ত।
এভাবে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা চালিয়ে যান অনেকেই। যে বা যারা এসব কথা বলেন, তারা চাইলেই দুজনের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে দুটো উৎসাহমূলক কথা বলতে পারতেন। সামান্য উৎসাহই রেবেকা আর নাজিয়ার মনোবল বাড়িয়ে দিতে পারত কয়েক গুণ।
দুঃসময়ে আঘাত করা : ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের এক বিশাল পরীক্ষা যেন দিতে হলো রাহাতকে। ছেলে বুয়েটে চান্স পায়নি? হায় হায় করতে করতে শেষ পাড়াপ্রতিবেশী আর সুযোগসন্ধানী আত্মীয়স্বজন। সবার প্রতিক্রিয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন রাহাতের বাবা-মা। এদিকে লজ্জা-অনুশোচনায় দগ্ধ রাহাত যেন বুঝেই উঠতে পারছিল না সে কী করবে।
যা-ই হোক, কঠিন সময়গুলো পেরিয়ে রাহাত একসময় চান্স পেয়ে গেল একটি ভালো ভার্সিটিতে। সঙ্গে সঙ্গে চেহারাগুলোও বদলে গেল সবার।
কয়েক বছর পরের কথা। সেই মানুষগুলোই রাহাতের কাছে তাদের ছেলেমেয়ের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসে। সাধ্যমতো সাহায্যও করে রাহাত। সেই কঠিন সময়টার স্মৃতি মনেও আনতে চায় না সে।
তাচ্ছিল্য করে কথা বলা : প্রতিবেশী মইনুল সাহেবের সঙ্গে দেখা হলেই অস্বস্তিবোধ করে সরকারি চাকরিজীবী হাসান। বয়সে বড় এই ভদ্রলোকটি হাসানকে দেখলেই চকচকে হাসিমাখা মুখে বলে ওঠে, ‘হাসান সাহেব, অফিস থেকে ফিরেছেন কখন? আপনাদের আর কী কাজ! বসে বসে বেতন পান। কাজ করে মরি আমরা, আর সুবিধা ভোগ করেন আপনারা।’
চাকরিক্ষেত্রে ভীষণ সৎ ও পরিশ্রমী হাসান নিত্যদিনের এই ঠাট্টায় খানিকটা কষ্ট পেলেও মুখে হাসি ধরে রাখেন ঠিকই। শুধু আগের চেয়ে একটু কম সামনে পড়ার চেষ্টা করেন মইনুল সাহেবের।
পরিস্থিতি বিবেচনা না করে কথা বলা : পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার নেহাল। পড়া শেষ করতেই চাকরি, আর সেই চাকরি সূত্রে অবস্থান করছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
তারই চাচাতো ভাই সিয়াম। পেশায় একজন ডাক্তার, এফসিপিএস পার্ট-২ শেষ করেছেন। দুই ভাইয়ে বেশ সখ্যতা সেই ছোটবেলা থেকে।
দেশের বাইরে থেকে যখনই বাসায় ফোন করে নেহাল, বাবা-মায়ের অভিযোগ থাকে, ইঞ্জিনিয়ার না বানিয়ে ছেলেকে ডাক্তার বানালেই বেশি ভালো হতো। বুড়ো বয়সে সিরিয়াল দিয়ে ডাক্তার দেখাতে হতো না তাদের।
ভিনদেশে বসে ভীষণ মন খারাপ হয় নেহালের। নিজেকে কেমন যেন অপরাধীও মনে হয়।
উল্টো চিত্র দেখা যায় সিয়ামের বাসায়। তার বাবা-মাও মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে। ইঞ্জিনিয়ার ভাই-বন্ধুরা যখন দেশে-বিদেশে ঘুরে ফিরে কাজ করছে, তখন তাদের ছেলেটি পরীক্ষা পাসের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবার-পরিজনকে সময়ও দিতে পারছে না প্রয়োজনমতো।
সবার অভিযোগে সিয়ামেরও মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়।
দুই ভাই ফোনালাপে কখনও কখনও একে অপরকে সাহস জোগায়।
এভাবে পরিস্থিতি না বুঝে মাঝে মাঝে আপন মানুষগুলোর বলা কথাও কষ্টের কারণ হতে পারে। বিভিন্ন পেশার মানুষের কাজের ধরন কিংবা জীবনযাপন ভিন্ন। তেমনি তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলোও আলাদা।
তাই প্রত্যেককে বুঝতে হবে তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে; অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নয়।
এড়িয়ে যেতে করণীয়
* এসব কথার তিক্ততা নির্মূল করার প্রধান ওষুধ হলো আত্মবিশ্বাস। কেউ যদি তার নিজের কাজ কিংবা নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখে এবং সব সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে সামনে এগোয়, তবে আর যা-ই হোক আত্মতৃপ্তি অর্জন করতে পারে খুব সহজেই। এছাড়াও অন্যের কথার বিপরীতে যুক্তিসংগত উত্তরও দেওয়া যায় বিনয়ের সঙ্গে।
* সবার চিন্তাভাবনা, ভালোলাগা-মন্দলাগা এক হয় না। তাই কিছু কথা একেবারেই কানে না তুলে এড়িয়ে যাওয়া দরকার।
* কোনো মানুষই নির্ভুল নয়। তাই অন্যের ভুলকেও ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। প্রয়োজন অনুসারে যেমন প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে, তেমনি হতে হবে সহনশীল।
* যে কথা শুনতে নিজেরা পছন্দ করি না, তা যেন কোনোমতেই অন্যকে না বলি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সবার আন্তরিকতা, ক্ষমাশীলতা আর স্বস্তিদায়ক কথায় সহজ ও সুন্দর হয়ে উঠুক পথচলা।
![]() সম্পাদক ও প্রকাশক : কাজী রফিকুল আলম । সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক আলোকিত মিডিয়া লিমিটেডের পক্ষে ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫ থেকে প্রকাশিত এবং প্রাইম আর্ট প্রেস ৭০ নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা, সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক বিভাগ : ১৫১/৭, গ্রীন রোড (৪র্থ-৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা-১২০৫। ফোন : ৯১১০৫৭২, ৯১১০৭০১, ৯১১০৮৫৩, ৯১২৩৭০৩, মোবাইল : ০১৭৭৮৯৪৫৯৪৩, ফ্যাক্স : ৯১২১৭৩০, E-mail : [email protected], [email protected], [email protected] |