বাংলাদেশে প্রথম এআই প্রস্তুতি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ
প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ২১:০৫ | অনলাইন সংস্করণ

নৈতিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবকেন্দ্রিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রথম জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রস্তুতি মূল্যায়ন (Artificial Intelligence Readiness Assessment–RAM) প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছে। এআই গ্রহণের মাধ্যমে অধিকার সুরক্ষা, অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করার পথনির্দেশ দেবে বলে এ প্রতিবেদনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) ঢাকার আইসিটি টাওয়ারের বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অডিটোরিয়ামে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, এটুআই, ইউনেস্কো এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে র্যাম প্রতিবেদনটি উন্মোচন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সরকারি মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা সংস্থা, বেসরকারি খাত এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
প্রতিবেদনটিতে এআই বিষয়ে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক, আইনগত, সামাজিক ও কারিগরি প্রস্তুতির প্রথম সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে এবং সরকারি ডিজিটাল সেবার প্রতি নাগরিকদের আস্থাও উচ্চমানের।
পাশাপাশি ঢাকার বাইরে অনিয়মিত ইন্টারনেট সংযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, শহর–গ্রামের দীর্ঘস্থায়ী ডিজিটাল বৈষম্য, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এবং তথ্য সুরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা ও এআই–সংক্রান্ত দক্ষতার ঘাটতির দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ে প্রকাশিত হলো।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর যুগে প্রবেশ করছে, যেখানে আজকের সিদ্ধান্তগুলো ভবিষ্যৎ সমাজকে বহু বছর প্রভাবিত করবে।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই প্রতিবেদন দেখায় বাংলাদেশ বর্তমানে কোন অবস্থানে আছে এবং কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বিচারের বিকল্প না হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আরও শক্তিশালী করে এবং নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখে।
আইসিটি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী চলমান নীতি–প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে, বিশেষত জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতি চূড়ান্ত করার সময় র্যাম প্রতিবেদনের বিশাল গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন।
তার মতে, নীতি–নির্ধারণ হতে হবে প্রমাণ–নির্ভর; অনুমান–নির্ভর নয়। তিনি বলেন, প্রতিবেদনের ফলাফল স্পষ্ট বিধান প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় জোরদার এবং জনসেবায় ব্যবহৃত এআই ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যাযোগ্য, জবাবদিহিমূলক এবং জাতীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে সহায়তা করবে।
ইউনেস্কোর এআই–সংক্রান্ত নীতিনির্দেশনা অনুসরণ করে প্রণীত এ র্যাম প্রতিবেদনে জাতীয় তথ্যবিশ্লেষণের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বিস্তৃত পরামর্শ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইউনেস্কো কার্যালয়ের প্রধান ও কান্ট্রি প্রতিনিধি ড. সুসান ভাইজ তার বক্তব্যে র্যাম প্রতিবেদনকে একদিকে শাসনব্যবস্থা, অবকাঠামো, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ও তথ্য–ভিত্তিক ব্যবস্থার অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন এবং অন্যদিকে অগ্রাধিকার নির্ধারণে দিকনির্দেশক রূপরেখা হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি তথ্য সুরক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা, বাংলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় উচ্চমানের তথ্যভান্ডার তৈরি এবং কন্যাশিশু ও নারীদের এআই–সংক্রান্ত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেন, এআই ব্যবধান কমাবে নাকি বাড়াবে তা নির্ভর করছে দেশগুলো এখন কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর। সংযোগ, দক্ষতা, ডেটা, কম্পিউটিং অবকাঠামো শক্তিশালী করা, নির্ভরযোগ্য নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি এবং জাতীয় সক্ষমতার সঙ্গে এআই কৌশল খাপ খাইয়ে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মত দেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এআই–সংক্রান্ত নীতিমালার ক্ষেত্রে ইউনেস্কোর সুপারিশ মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং সুশাসনকে শক্তিশালী করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এটুআই কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহা. আবদুর রফিক র্যাম প্রতিবেদনে উত্থাপিত সুপারিশগুলো সেবাদানে দৃশ্যমান উন্নতিতে রূপান্তরের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ও বিচারব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে বাস্তব সমস্যার কার্যকর সমাধান দিতে পারে।
তার মতে, র্যাম প্রতিবেদন নাগরিক–মুখী সেবায় এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতার নির্দেশনা দেবে, যাতে মানুষ দ্রুততর, ন্যায্য ও নির্ভরযোগ্য সেবা পায় এবং একই সঙ্গে বিদ্যমান ডিজিটাল বৈষম্য যেন আরও না বাড়ে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দপ্তরের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের প্রধান মিখাল ক্রেজা আশা প্রকাশ করেন যে এই প্রতিবেদন একটি আস্থাভিত্তিক এআই ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
তার মতে, উদ্ভাবনের সুফল যেন তরুণ, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সব নাগরিকের কাছে পৌঁছে যায়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ভবিষ্যতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
