ঈশ্বরদীর রত্নগর্ভা মা হাসিনা বানুর সংগ্রামী জীবনের গল্প

প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৬:২০ | অনলাইন সংস্করণ

  ইশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি

শিক্ষিত, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ সন্তান জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর এই রত্নসম সন্তানদের গড়ার পেছনে যিনি থাকেন, তিনিই রত্নগর্ভা মা। এমনই এক অনন্য উদাহরণ পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর গ্রামের মোছা. হাসিনা বানু। যিনি একা হাতে দুই সন্তানকে বড় করে তুলেছেন। এখন তারা দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক।

বর্তমানে ৭৫ বছর বয়সী মোছা. হাসিনা বানু একজন সংগ্রামী নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর মাত্র দুই বছরের এক ছেলে ও সাতদিনের এক নবজাতক কন্যাকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। কিন্তু তিনি হার মানেননি। অদম্য মানসিক শক্তি নিয়ে সন্তানদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলেন। তার এই আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ফলেই আজ তার দুই সন্তান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিষ্ঠিত।

বড় ছেলে ড. মো. এনামুল হক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার বায়োসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক। ছোট মেয়ে অধ্যাপক আমিনা পারভীন বর্তমানে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মোছা. হাসিনা বানুর জন্ম ১৯৪৯ সালের ৮ মার্চ, ঈশ্বরদীর সাহাপুর গ্রামে। তার বাবা হারেজ উদ্দীন মালিথা পেশায় জমিদার ছিলেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় এবং বড় মেয়ে। প্রাথমিক পড়াশোনার পর পাশের গ্রামের কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ আশরাফ আলীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল মাত্র চার বছর চার মাস। ১৯৭১ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে কঠিন সময় শুরু হয় হাসিনা বানুর জীবনে।

তবে বাবার আর্থিক সহযোগিতা এবং নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি সন্তানদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেন। বড় ছেলে এনামুল হক ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা শেষে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পান।

অন্যদিকে, মেয়ে আমিনা পারভীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এবং পরে সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার্স ইন সোশ্যাল ওয়ার্ক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে শাবিপ্রবিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে শাবিপ্রবির প্রথম নারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

রত্নগর্ভা মা মোছা. হাসিনা বানু বলেন, ‘বাবার অবস্থা ভালো থাকলেও সংগ্রাম ছিল অনেক। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল—সন্তানদের মানুষ করা। আমি জেদ করেছিলাম, আমাকে কেউ যেন বলতে না পারে আমি অশিক্ষিত বলে আমার সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারিনি। আজ সে জেদ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।’

তার কন্যা অধ্যাপক আমিনা পারভীন বলেন, ‘আমি যেখানে আছি, তা সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের কারণে। তার সাহস, আদর্শ ও শিক্ষা আমাকে সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে।’

মোছা. হাসিনা বানুর জীবন কাহিনি শুধু তার পরিবার নয়, গোটা সমাজের জন্য এক মহান অনুপ্রেরণা। তার সংগ্রাম ও সফলতা প্রমাণ করে—একজন মায়ের আদর্শ, জেদ ও সাহসই পারে একটি জাতিকে আলোকিত করতে।