আখাউড়ায় শখের নার্সারিতে কাদিরের ভাগ্য বদল
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৫, ১৬:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ
ফরহাদুল ইসলাম পারভেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

সকাল থেকেই চলছে নার্সারি বাগানে পরিচর্যা। এর মধ্যে কেউ করছেন জৈব সারে মাটি উর্বর, জিও ব্যাগে বীজ রোপণ, চারা রোপণ, আবার কেউ বা করছেন বিক্রির জন্য চারা উত্তোলন। নার্সারির মালিকসহ শ্রমিকরা এক প্রকার ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এমন দৃশ্য দেখা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের দেবগ্রাম এলাকায় মো. আব্দুল কাদির ভূঁইয়ার নার্সারিতে।
শখের বশে বাণিজ্যিকভাবে নার্সারির বাগান গড়ে তুলে তিনি ভাগ্য বদল করেছেন। বর্তমানে তার এই নার্সারিতে দেশি-বিদেশি প্রায় শতাধিক প্রজাতির ফল, ফুল আর বনজ আর ভেষজসহ অন্তত তিন লাখ নানা প্রজাতির গাছের চারা শোভা পাচ্ছে।
এরমধ্যে রয়েছে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, কামরাঙ্গা, বেল, জামরুল, আপেল, কমলা মাল্টা, লিচু, পেঁপে, আনাড়, রাম্বুটান, লংগান, এভোকাডো, ডুরিয়ান, নাশপাতি, আপেল, আমড়া, বড়ই, পিয়ারা, বেল, নারিকেল, বেলজিয়াম, আকাশি, মেহগনি, শিলকড়ুই, সেগুন, জামসহ নানা প্রকারের গাছের চারা।
সেই সঙ্গে বাগানে রয়েছে লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, রজনিগন্ধা, সূর্যমুখী, হাসনাহেনা, গাঁদা, বেলি, কামিনী, হাসনাহেনা, রঙ্গন, শেফালি ফুলসহ নানা প্রকারের ফুলের চারা।
জীবিকার তাগিদে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আনতে কঠোর পরিশ্রম করে পতিত জমিতে নার্সারি বাগান গড়ে তুলে প্রতিমাসে যাবতীয় খরচ বাদে ৫০ হাজার টাকা তিনি আয় করছেন।
কাদির ওই এলাকার মো. বাহার মিয়ার ছেলে। পরিবারে তার স্ত্রী, ১ ছেলে ১ মেয়ে রয়েছে। এ দিকে নার্সারিতে ভালো মানের চারা হওয়ায় স্বল্প সময়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এই দৃষ্টি নন্দন বাগান দেখতে দৈনিক বিভিন্ন জায়গার লোকজন এখানে আসছেন এবং এ সফলতা দেখে অনেকেই ফুল-ফলের বাগান করতে নানা প্রজাতির গাছের চারা ক্রয় করছেন। এ কারণে ক্রেতার সংখ্যা ক্রমেই দিন দিন বাড়ছে।
পৌর শহরের দেবগ্রাম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নার্সারির পরিচর্যা নিয়ে মালিকসহ শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরমধ্যে কেউ করছেন জৈব সারে মাটি উর্বর, জিও ব্যাগে বীজ রোপণ, চারা রোপণ, আবার কেউ বা করছেন বিক্রির জন্য চারা উত্তোলন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলছে কাজ।
কাদির ভূঁইয়া বলেন, আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে জীবিকার তাগিদে শ্রমিকের কাজ করা হতো। দৈনিক যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে চলত সংসার। ছোট একটি ঘরে পরিবার নিয়ে কষ্ট করে থাকা হতো। শ্রমিকের কাজে সংসার চালাতে কষ্ট হওয়ায় বিকল্প পেশা খোঁজার চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে নার্সারি চারা বিক্রি করতে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। প্রথমে স্বল্প পুঁজি নিয়ে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নানা প্রজাতির গাছের চারা এনে স্থানীয় হাট বাজারে বিক্রি শুরু করি। এতে ভালো আয় হওয়ায় মনে উৎসাহ তৈরি হয়। পরে বাড়ি সংলগ্ন মাত্র ৪ শতাংশ জায়গায় বেলজিয়াম, আকাশি, মেহগনি, শিল কড়ুই, জাম, কাঁঠাল গোলাপ, জবা, ডালিয়া, সূর্য্যমুখি, হাসনাহেনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও বৃক্ষ চারা রোপণ করি। সব মিলিয়ে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর শুরু করি পরিচর্যা। চারাগুলো বড় হলে বিক্রিতে ভালো টাকা আয় হয়। এতে আমার উৎসাহ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। পরের বছর ২০ শতাংশ জায়গা ইজারা (ভাড়া) নিয়ে ২০-২৫ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা করে দ্বিগুণ টাকা আয় হয়।
বর্তমানে বাড়ি সংলগ্ন নিজ ও ভাড়াসহ ৪ বিঘা জায়গার মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষাধিক নানা প্রজাতির গাছের চারা রয়েছে। শখের বসে আমার নিজের নামে নার্সারির নাম দেওয়া হয়। এই নার্সারি বাগানে দৈনিক মজুরিতে ৩ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছে। পাশাপাশি পরিবারের লোকজন সহযোগিতা করছেন।
কাদির ভূঁইয়া আরো বলেন, আমার নার্সারি বাগানে দেশি-বিদেশি ফুল, ফল, ঔষধিসহ সৌন্দর্যবর্ধন নানা প্রজাতির চারার গুণগত মান ভালো হওয়ায় প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে চারা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। তাছাড়া প্রতিদিন পৌর শহরসহ উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে ভ্যান গাড়ি করে চারা বিক্রি করছি। আমার এই নার্সারিতে নিচে ৫০ টাকা উপরে ২ হাজার টাকা দামের চারা রয়েছে। দৈনিক ১৫-২০ হাজার টাকার ওপর চারা বিক্রি হয়। প্রতি মাসে যাবতীয় খরচ বাদে ৫০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান।
নার্সারি ব্যবসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি খুবই লাভজনক ও ঝুঁকিহীন ব্যবসা। যে কারণে এ ব্যবসার প্রসার ঘটছে। বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য এ ধরনের পেশা সম্ভাবনাময়।
চারা ক্রয় করতে আসা পৌর শহরের মসজিদ পাড়া এলাকার মো. বাবুল মিয়া বলেন, বাগান করার শখ থাকা সত্ত্বেও চারার অভাবে করা হয়নি। এখানে নার্সারি বাগান গড়ে তুলায় নানা প্রজাতির চারা সংগ্রহ করে বাড়ির আশপাশে লাগিয়েছি। আজকেও আম, রাম্বুটান ও নারকেলের চারা ক্রয় করেছি। এখানের চারার মান খুবই ভালো।
চানপুর এলাকার মো. আকরাম হোসেন বলেন, গত দুই বছর হলো নতুন বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বাড়ির পাশে খোলা জায়গা থাকায় ফল ও ফুলের বাগান করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। লোকমুখে শুনে এই নার্সাারিতে আসা। নার্সারি বাগান ঘুরে দেখে দেশি-বিদেশি জাতের বেশ কয়েকটি ফল ও ফুলের চারা ক্রয় করা হয়েছে।
গৃহিণী শিরিন আক্তার বলেন, বাড়ির সামনে পেছনে খালি জায়গা রয়েছে। আমার ইচ্ছা ফুল ফলের বাগান করার। তাই নিজে দেখে ফুল ফলের ৪০টি চারা ক্রয় করেছি।
দেবগ্রাম এলাকার বাসিন্দা মো. সজল আহমদ খান বলেন, উপজেলার মধ্যে এটি হলো একটি বড় নার্সারি। এখানে ফল, ফুলসহ নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের চারা রয়েছে। প্রতিদিন দূরদূরান্তের লোকজন এসে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরাও চারা নিয়ে বাড়ির আশপাশে ও ছাদে রোপণ করছি।
আখাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অনেকে নার্সারি বাগান করেছে। কৃষি অফিসের লোকজন নিয়মিত পরিদর্শন ও পোকামাকড় আক্রমণ থেকে মুক্তির জন্য তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে কাদির ভূঁইয়ার নার্সারি এরই মধ্যে শৌখিন ব্যক্তিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশা লোকদের কাছে বেশ সাড়া ফেলেছে। যারা নার্সারিসহ অন্যান্য চাষে এগিয়ে আসবে তাদেরকে সার্বিকভাবে সহায়তা করা হবে।
