গরু মহিষ নিয়ে লোকালয়ে চরের খামারিরা, ঘাস ফুরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ২২:০৬ | অনলাইন সংস্করণ
আলমাস আলী, ঈশ্বরদী (পাবনা)

ঈশ্বরদী-বাঘা আঞ্চলিক মহাসড়কের এয়ারপোর্ট মোড়ের পাশেই দেখা মেলে ছাতা মাথায় দিয়ে মহিষ চড়াচ্ছেন এক নারী। কয়েকদিন আগে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধিতে চর তলিয়ে গেলে নিজের বাসস্থানসহ মহিষের খাবারের অভাব দেখা দেয়। তখন তিনি সহ অনেক খামারিই চর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নদী পার হয়ে লোকালয়ে বিভিন্ন গ্রামে চলে আসেন।
বুধবার বিকেল চারটায় কথাগুলো বলছিলেন ছাতা মাথায় দিয়ে মহিষ চরানো সোহানী খাতুন। তিনি জানান, ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের পদ্মা নদীর জেগে ওঠা মোল্লারচরে তার বাড়ি। পুরো চর ডুবে তলিয়ে যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই তিনি স্বামী ফেলা মন্ডল ও তাদের খামারে পালিত তিনটা বড় ও একটা ছোট মহিষের বাচ্চা নিয়ে এপারে পুরোনো রেললাইনে মোল্লাপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা দুই বছর ধরে ছোট আকারে মহিষের খামার করেন। তাদের কোনো জায়গা জমি নেই। চরাঞ্চলের সবুজ তৃণভূমির ঘাস খেয়েই মহিষ পালন করেন।
কিছুদূর এগিয়েই দেখা যায়, ১০ বছর বয়সের ছেলে সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার পাশের পরিত্যক্ত জমিতে মহিষ চরাচ্ছেন আনারুল মন্ডল। তিনি জানান, উপজেলার সাঁড়া ইউনিয়নের চরজাজিরা মৌজার বাসিন্দা তিনি। তার খামারে নয়টি মহিষ রয়েছে। তারও সোহানি খাতুনের মতোই কোন নিজস্ব জায়গা জমি নেই। চর জেগে থাকলে ঘাস খাওয়ায় এই মহিষ পালন করেন। তিনি ১১ বছর ধরে মহিষ পালন করেন। আগে তার গরুর খামার ছিল। চর পুরোপুরিভাবে তলিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই তিনি নদী পার হয়ে উপজেলার ইলশেমারি গ্রামে আত্মীয় হাবিবের বাড়িতে ছাপরা করে রয়েছেন।
তিনি আরো জানান, যেসব খামার মালিকের জায়গা জমি রয়েছে তাদের উঁচু জমিতে ধৈঞ্চাসহ মহিষের খাবার রয়েছে তাদের মহিষ পানি ছাপিয়ে গিয়ে ধৈঞ্চা খেয়ে আসছেন। তার মহিষের কোন খাবার না থাকায় তিনি পুরো চর তলিয়ে যাওয়ার আগেই লোকালয়ে চলে এসে রাস্তার পাশে কোথাও পরিত্যক্ত জমি থাকলে সেখানেই ঘাস খাওয়াচ্ছেন। তার সাথে মহিষ চড়াচ্ছেন তার পঞ্চম শ্রেণীতে পর্যন্ত পড়ুয়া ছেলে সাইফুল ইসলাম। চারণভূমি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় তিনি-সহ অন্তত অর্ধশতাধিক খামারি লোকালয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছেন।
জানা গেছে, ঈশ্বরদী উপজেলার সাড়া ইউনিয়নের চরজাজিরা ও মোল্লাচরে ৬০ জন বাসিন্দা। পদ্মার চরে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক মহিষের খামার। তাদের খামারে প্রায় ১০০০ মহিষ রয়েছে। চরের বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমিতে ঘাস খাইয়ে মহিষ পালন করেন এখানকার খামার মালিকরা। চর পানিতে ডুবিয়ে গেলে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে লোকালয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন গরু মহিষ সহ গৃহপালিত পশু।
পাকশী ডিগ্রী কলেজে এলাকায় মহিষ চড়াচ্ছেন মিজানুর রহমান নামে এক খামারি। তিনি বলেন, এখন লোকালয়ে এসে আরও বেশি বিপদে পড়েছি। এখানে হয়ত আর দু-দিন পর ঘাস শেষ হয়ে যাবে। তখন কোথায় যাব জানি না। যদি সরকারিভাবে কোথাও গরু-মহিষগুলো রাখার ব্যবস্থা করতো তাহলে খুব ভালো হতো।
তিনি বলেন, ‘সারাদিন মহিষ চড়িয়ে রাতেও মহিষের খেয়াল রাখতে হয়। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো ইদানীং চরের জমি যারা সরকারের কাছ থেকে বার্ষিক লিজে নেয়; তাদের কাছ থেকে খুব চড়া দামে লিজ নিয়ে মহিষ চরাতে হয়। চরের জমি যদি মহিষ-গরুর খামার মালিকরা সরাসরি লিজ নিতে পারতো, তাহলে গরু-মহিষ পালনে খরচ কমে যেত।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঈশ্বরদীর পদ্মা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় চরগুলো ডুবে গেছে। তাই গরু- মহিষ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চলে এসেছেন অনেকে।
চার বছর পর চরগুলো এবার পুরোপুরি ডুবে গেছে। চরগুলো ঈশ্বরদী শহর থেকে পশ্চিমে। এসব এলাকার খামারিরা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন গৃহপালিত পশু। কেউ নদীসংলগ্ন বাঁধের পাশে খোলা আকাশের নিচে, কেউ আবার কোন আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউবা আগে থেকেই অস্থায়ী বাথানে মহিষ নিয়ে আসেন, কেউবা খালি জায়গা পেয়ে গরু মহিষ গুলো রেখেছেন।
বুধবার বিকেলে দেখা যায় কিছু মহিষ সড়কের পাশে ঘাস খাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে গোপালপুর গ্রামে দোয়াল বাড়িতে (অস্থায়ী রাখার জায়গা) কিছু মহিষ শুয়ে আছে। কথা বলে জানা গেল, তারা চর তলিয়ে যাওয়ার আগেই এই এলাকায় রয়েছেন।
জাফর আলী নামে একজন খামারি বলেন, তাদের মহিষগুলো চরে মুক্তভাবে চরে বেড়াত ঘাস খেত। এখানে ঘাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। চরের পানি কমতে গুরু হয়েছে। পানি নামলেও চরের ঘাস সব পচে যাবে। খামারের মহিষ শুধু সবুজ ঘাস খেতে পছন্দ করে। বর্ষাকালে নদীর চর ডুবে গেলে এদের ধানের খড়, ধানের গুড়া, ও ভুসি খেতে দেওয়া হয়। এগুলো খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। মহিষ অপরিচিত মানুষ দেখলে তাকিয়ে থাকে এবং ছোটাছুটি করে। নদীর চরেই তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোছা. আকলিমা খাতুন বলেন, পদ্মা নদীর পানি বিগত বছরের তুলনায় এবার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
দু-একটি পরিবার ছাড়া সবাই তাদের প্রাণিগুলো উপজেলার আরামবাড়িয়া, বাঘইল, গোপালপুর, মাজদিয়া পুরাতন রেল লাইন, ইলশেমারিসহ আশপাশের গ্রামাঞ্চলে নিয়ে এসেছেন।
বন্যার এই দুইমাস গবাদিপশুর খাদ্যসংকট দেখা দেয়। আওর (খড়), মসুর গাছের ভুসি, মাষকলাই গাছ, খেসারীর হে (খেসারির ফল আসার সময় গাছগুলো রোদে শুকায়ে পালা দিয়ে রাখা হয়), চরের ধৈঞ্চা গাছ, আখ গাছ, গামা ঘাস, গমের ভুসি এইগুলো খামারিরা তাদের গবাদিপশুগুলোকে খাওয়াচ্ছেন। পাশাপাশি রেল লাইন, পাকশী, ঈশ্বরদী বাঘা আঞ্চলিক সড়কের পাশে-সহ আশেপাশের মাঠে প্রাণিগুলোকে চরাচ্ছেন।
প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরামর্শে কিছু কিছু খামারি হে তৈরি করে রেখেছিলেন, এখন তার সুফল পাচ্ছেন।
