নারায়ণগঞ্জে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা, বছরে বন্ধ ৬৪ কারখানা
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৭:৩৮ | অনলাইন সংস্করণ
মোশতাক আহমেদ শাওন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের পোশাক শিল্পে অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত এক বছরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, ব্যাংকের উচ্চ সুদ, গ্যাস সংকট, শ্রমিক আন্দোলন, বিদেশি বায়ারের অনাগ্রহ, আর্থিক চাপ ও সিন্ডিকেটের প্রভাবসহ নানা কারণে অন্তত ৬৪টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক ও কর্মচারী।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-৪ এর তথ্যমতে, জেলায় মোট কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৮৩৪টি। এর মধ্যে আরএমজি ৪২৪টি এবং নন-আরএমজি ১ হাজার ৪১০টি। গত এক বছরে স্থায়ীভাবে ৪০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে, অস্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে ২০টি, লে-অফ হয়েছে ২টি এবং শ্রম আইন ১৩(১) ধারায় ১টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কারখানা মালিকদের অভিযোগ, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ফলে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে অনেক শিপমেন্ট বাতিল হচ্ছে এবং বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করতে হচ্ছে। শিল্পপতিরা বলছেন, সমন্বিত সেবার অভাবে উৎপাদন ও রপ্তানি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি—একটি সমন্বিত ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস’ চালু করা, তবে এ ব্যাপারে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই।
অ্যাসরোটেক্স গার্মেন্টসের মালিক আসাদুল ইসলাম বলেন, “লাভ না হলেও শ্রমিকদের বেতন কখনো আটকে রাখিনি। তারপরও তুচ্ছ দাবিতে আন্দোলনের কারণে বিদেশি বায়াররা ভয়ে সরে গেছেন। এখন আর ইচ্ছা করলেও কারখানা খোলা সম্ভব নয়।”
একইভাবে এএসটি গার্মেন্টসের মালিক আতিকুর রহমান জানান, অর্ডার কমে যাওয়া ও আর্থিক সংকট সামাল দিতে না পেরে ভর্তুকি দিয়েও কয়েক মাস চালিয়ে অবশেষে কারখানা বন্ধ করতে হয়েছে।
এদিকে শ্রমিক সংগঠন বলছে, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের অনেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউ ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়িতে, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এম এ শাহীন বলেন, “এভাবে একের পর এক কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকদের দুর্দশা আরও বাড়বে।”
সংকটের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিকেএমইএ সভাপতি এম এ হাতেম বলেন, “তিনটি কারণে গার্মেন্টস শিল্প চরম সংকটে পড়েছে—প্রথমত ব্যাংকিং জটিলতা, দ্বিতীয়ত কিছু বিদেশি বায়ারের অনৈতিক ব্যবসায়িক আচরণ, তৃতীয়ত গ্যাস সংকট। এই তিন আঘাতেই মালিক ও শ্রমিক উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র ঘোষ জানান, তাদের চেষ্টা থাকে যেন কোনো কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ না হয়। তবে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-৪ এর পরিদর্শক সেলিম বাদশা বলেন, “বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অনেক কারখানা আবারও উৎপাদনে গেছে। কোথাও কোথাও কাজের চাপ কম থাকলেও পরিস্থিতি একেবারে নিরাশাজনক নয়।”
তবে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু বলেন, বিদেশি বায়ার না পাওয়া, আর্থিক সংকট ও সিন্ডিকেটের কারণে শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অনেক মালিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আত্মগোপনে চলে গেছেন।
তার মতে, “শিল্পকে ধ্বংস করতে দেশের বাইরে থেকেও নানা শক্তি কাজ করছে। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে।”
এদিকে অস্থিরতার কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ায় শুধু শ্রমিক নয়, তাদের পরিবারের সদস্যরাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন।
