বোয়ালমারী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশঝাড়

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৮:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

  বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি

আধুনিকতার ছোঁয়ায় ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশঝাড়। বাঁশের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য কুটির শিল্প। এ শিল্পের সাথে জড়িতরা এখন তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে।

বোয়ালমারী উপজেলার ময়না, কেওয়াগ্রাম, মিরেরচর, বাবুর বাজার, চন্দনী, কামারগ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃতির পরম বন্ধু এই বাঁশঝাড় বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় এই বাঁশঝাড় টিকিয়ে রাখার তাগিদ দিচ্ছেন পরিবেশবিদ ও প্রকৃতি প্রেমিরা।

প্রাচীন সময় গ্রাম বাংলায় বাঁশঝাড় ছিল না এমনটা কল্পনাও করা যেতো না। যেখানে গ্রাম সেখানে বাঁশঝাড় এমনটিই ছিল স্বাভাবিক। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়ের ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার চিরায়ত রূপ। বিশ্বে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। বাংলাদেশে জংলি ও আবাদি প্রকৃতির ২৬ প্রজাতির বাঁশ জন্মে। কিন্তু বনাঞ্চলের বাইরেও এখন যেভাবে গ্রামীণ বৃক্ষরাজি উজাড় হচ্ছে তাতে হারিয়ে যাচ্ছে এ বাঁশঝাড়।

বাঁশ একটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। বাঁশের বিস্তৃতি অতি ব্যাপক। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কম-বেশি এটা জন্মায়। এ দেশের বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট বাঁশের গুরুত্ব অপরিসীম। গৃহনির্মাণ, মঞ্চ নির্মাণ, মই, মাদুর, ঝুড়ি, ফাঁদ, হস্তশিল্পসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য বিবিধ জিনিসপত্র তৈরির কাজে বাঁশের রয়েছে বহুল ব্যবহার। 
প্রকৃতপক্ষে বাঙালির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশ। জন্মের পর বাঁশের চাঁছি দিয়ে নাড়ি কাটা হয়। তারপর বাঁশের তৈরি দোলনায় দোল খায় বাঙালি শিশুরা। মৃত্যু’র পর বাঁশের খাটিয়ায় তুলে বাঙালি শেষযাত্রা করে। কবরের ওপরে বাঁশ বিছিয়ে তারপর মাটি দেওয়া হয়। বাঙালির দোলনাও বাঁশের, সমাধিও বাঁশের।

বাঁশসহ বৃক্ষ নিধনের ফলে দৈনন্দিন জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। অথচ জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়া রোধে সহায়তা করতে পারে এই বাঁশ গাছই। বাঁশ গাছ অন্য যে কোন গাছের তুলনায় দ্রুত গতিতে ক্ষতিকর কার্বন গ্যাস শুষে নিতে সক্ষম এবং এর শিকড় মাটি ক্ষয়ে যাওয়া রোধ করতে পারে। জেলার জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প। এক সময় এ গ্রামীণ জনপদে তৈরি হতো হাজারো বাঁশের পণ্য সামগ্রী। ঘরের কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ কেটে গৃহিণীরা তৈরী করতেন হরেক রকম জিনিস। অনেকে এ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু বাঁশের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্য ‘কুটির শিল্প’। প্রকৃতপক্ষে বাঁশ শিল্পের স্থান অনেকটাই প্লাস্টিক সামগ্রী দখল করে নিয়েছে।

স্থানীয় একজন কৃষক জানান, আগে জমির দাম কিছুটা কম থাকায় বাঁশঝাড়গুলো সংরক্ষিত ছিলো। এখন জমির দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় বাঁশঝাড় কেটে জমি বিক্রি করা হচ্ছে। এসব জায়গায় গড়ে উঠেছে বসতিসহ নানান স্থাপনা। এছাড়া ইটভাটার জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাঁশের গুড়ি।

কয়েকজন বাঁশ বাগানের মালিকের সাথে কথা হলে তাঁরা বলেন, আগে আমাদের বাঁশঝাড় অনেক বড় ছিলো। এখন এর প্রতি গুরুত্ব না দেয়ায় অনেক কমে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ঝাড় কমে যাওয়ায় এখন বাঁশ আর সহজলভ্য নয়। এ কারণেই দিনে দিনে বাড়ছে বাঁশের দাম। কিছুদিন আগেও একটি বাঁশের দাম ছিলো ১০০ টাকা। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

কয়েকজন বাঁশ ব্যবসায়ি জানান, বাঁশঝাড়গুলো আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে। পুনরায় জন্ম নিচ্ছে না। তাই আমাদের বাঁশ কিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাঁশের আগের মতো ঝাড় নেই।

বোয়ালমারী উপজেলার ময়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালিপদ চক্রবর্ত্তী জানান, এক সময় ফরিদপুর জেলায় ৯৯ শতাংশ ঘর ছিল বাঁশের খুঁটির উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও ঘরের বেড়া, চালা, অবকাঠামো নির্মাণ, রান্নাঘর ও কৃষি ক্ষেতসহ পরিবারের অনেক কাজেই বাঁশের ব্যবহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ।