সমস্যায় জর্জরিত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১৬:৪৭ | অনলাইন সংস্করণ
সিদ্দিক হোসেন, দিনাজপুর

দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ (দিমেক) হাসপাতাল যেন চলছে টোটকা চিকিৎসা দিয়ে। অধিকাংশ চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি নষ্ট, চিকিৎসক সংকট তীব্র। এ ছাড়া দালালচক্রের দৌরাত্ম্যে প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। প্রায় এক যুগ ধরে অচল হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্র। সিটি স্ক্যান মেশিন দীর্ঘদিন নষ্ট থাকার পর মেরামত হলেও ফিল্ম না থাকায় সেটিও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ফিলিপস কোম্পানির এমআরআই যন্ত্র, যা ২০১৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিল। মাত্র তিন বছর সচল থাকার পর হিলিয়ামের লেভেল কমে যায়। পরে মেরামতের ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মোট ৫৫৫টি যন্ত্রের মধ্যে ২৫৭টি অচল অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে যেমন বড় যন্ত্র এমআরআই ও সিটি স্ক্যান রয়েছে, তেমনই ছোট যন্ত্র পালস অক্সিমিটারও আছে।
রোগীদের অভিযোগ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার বাইরে বেশিরভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করাতে হয়, যেখানে সরকারি হারের চেয়ে ২০-৪০ শতাংশ বেশি খরচ গুনতে হয়।
তারা জানান, বাইরে গিয়ে এমআরআই করাতে হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার টাকায়, যেখানে সরকারি হাসপাতালে ফি ৩ হাজার টাকা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৫০০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন ভর্তি থাকেন ৯০০ থেকে ১১০০ জন রোগী। শিশু ওয়ার্ডে ৩৯ শয্যার জায়গায় কখনো কখনো রোগী থাকে ১৪০ জন পর্যন্ত। চিকিৎসকদের ২১২টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১১১ জন—প্রায় ৪৮% পদ শূন্য। নিউরোসার্জারি বিভাগে রয়েছেন মাত্র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যিনি সপ্তাহে দুই দিন অপারেশন করেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের করিডোরজুড়ে অবস্থান করছেন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধি। অভিযোগ আছে, কিছু চিকিৎসক ও আউটসোর্সিং কর্মী রোগীদের এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে কমিশন নেন।
এ ছাড়া আউটসোর্সিংয়ে অনুমোদিত ২৩৬ জনের পরিবর্তে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩৮৮ জন। এর মধ্যে অনেকেই হাসপাতালে না এসেও বেতন নিচ্ছেন। কর্মীদের কাছ থেকে বেতনের একটি অংশ কেটে নেওয়া হয়।
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, খাবার পানির অভাবে রোগী ও স্বজনদের বাইরে থেকে বোতলজাত পানি কিনে আনতে হচ্ছে। হাসপাতালের সরবরাহ করা খাবারও অনেক ক্ষেত্রেই মানসম্মত নয়। অনেক রোগীই খাবার না খেয়ে বাইরে থেকে কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন।
হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘সিলিং ফ্যানগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে গায়ে বাতাসই লাগে না। তীব্র গরমে বেডগুলোতে তেলাপোকা আর ছারপোকার উপদ্রব বেড়ে গেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই থাকতে বাধ্য হচ্ছি।’
তারা আরও বলেন, ‘হাসপাতালে ২-৪টি ওষুধ দেওয়া হয়, কিন্তু স্যালাইনসহ বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। দামি কোনো ওষুধই সরবরাহ করা হয় না।’
হাসপাতালের বেশিরভাগ পরীক্ষার যন্ত্রাংশ নষ্ট। শুধু রক্তের কয়েকটি পরীক্ষা হয়। বড় টেস্টের জন্য রোগীদের বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। হাসপাতালের ভেতরেই এসব সেন্টারের প্রতিনিধি বসে থাকেন।
চিকিৎসক সংকট, যন্ত্রপাতির অচলাবস্থা এবং শয্যা সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শ্যামলী সাহা। তিনি জানান, চতুর্থ তলা সম্প্রসারণের কাজ শেষে কিছু রোগীর বেড স্থানান্তর করা হয়েছে। আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে প্রশাসনিক পদগুলো শূন্য থাকায় একজনকে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বর্তমানে প্রশাসনিক পদ চারটি হলেও এর মধ্যে মাত্র দুজন কর্মরত আছেন। তাঁদের চারজনের কাজ সামলাতে হচ্ছে। যত দ্রুত এসব পদ পূরণ করা যাবে, স্বাস্থ্যসেবার মান তত দ্রুত উন্নত করা সম্ভব হবে।
