উখিয়ার বরাদ্দকৃত অ্যাম্বুলেন্স চলছে কুতুবদিয়ায়!
সরকারি নথিতে বরাদ্দ ৪টি, কার্যকর ১টি
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া। এখানে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম প্রধান অবলম্বন অ্যাম্বুলেন্স। অথচ সেই ভরসা আজ পরিণত হয়েছে জনদুর্ভোগের প্রতীকে। সরকারি নথিতে চারটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও বাস্তবে সচল আছে মাত্র একটি। ফলে উখিয়ার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ও ১৫ লাখ রোহিঙ্গা দীর্ঘ চার বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ সরকারি এই সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছেন।
সরকারি গাড়ি অচল হয়ে পড়ায় রোগী পরিবহনে নির্ভর করতে হচ্ছে বেসরকারি সেবার ওপর। আর এজন্য গুনতে হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা ভাড়া। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি এক অমানবিক চাপ।
২০২৩ সালের মার্চে রাজাপালং ইউনিয়নের টাইপালং গ্রামের নুর জাহান বেগম (৭০) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকরা তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় এনজিওর সহযোগিতার পরামর্শ দেওয়া হয়। রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতি হওয়ায় তার ছেলে হাজী ছালামত উল্লাহ নিরুপায় হয়ে তিন হাজার টাকায় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। পথেই মারা যান নুর জাহান।
শোকাহত ছালামত উল্লাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। অথচ আমরা উখিয়ার মানুষ সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। মাকে হারালাম শুধু সঠিক সময়ে সরকারি সেবা না পাওয়ার কারণে। অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা পাইনি।
সরকারি নথিপত্র অনুসারে, উখিয়ায় প্রথম অ্যাম্বুলেন্স আসে ২০০২ সালে। মডেল এল-৩০০ গাড়িটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) মেরামত করলেও বর্তমানে অকেজো হয়ে গাড়িশালায় পড়ে আছে।
২০১৭ সালে আসে দ্বিতীয় অ্যাম্বুলেন্স—আকিজ মিনি মডেল। সেটি সচল করা হলেও পরে কক্সবাজার সিভিল সার্জনের নির্দেশে রহস্যজনকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয় কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
একই বছরে পাওয়া আরেকটি এল-৩০০ মডেলের গাড়ি বর্তমানে সচল রয়েছে। এটিই একমাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, যা ২৪ ঘণ্টা রোগী পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সর্বশেষ ২০২৩ সালে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির অনুদানে পাওয়া টয়োটা হাইএস মডেলের অ্যাম্বুলেন্সটি সচল থাকলেও এখনো কাগজপত্র হস্তান্তরের কাজ শেষ না হওয়ায় সেটি গাড়িশালায় অব্যবহৃত অবস্থায় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে তিনটি কার্যত জনগণের কাজে লাগছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি সেবা সচল না রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে এনজিওর রেফারেল সিস্টেমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বিশেষত রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত এনজিওগুলো রোগী পরিবহনে সক্রিয় থাকায় সরকারি গাড়িগুলো অচল অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে উখিয়ার সাধারণ মানুষ প্রকৃত সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেসরকারি সেবার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাজাপালং ইউনিয়নের এক শিক্ষক বলেন, এখানে চারটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকা সত্ত্বেও আমরা কোনোটির সেবাই পাচ্ছি না। প্রতিদিনই কেউ না কেউ চিকিৎসা না পেয়ে বা হাসপাতালে পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় মারা যাচ্ছেন। বিষয়টি প্রশাসনিক অবহেলার বড় উদাহরণ।
উখিয়ার এক বড় অংশ সাগর ও পাহাড়ি গ্রামাঞ্চল। এসব এলাকায় সড়কপথের দুরবস্থা থাকায় জরুরি মুহূর্তে রোগী পরিবহন আরও কঠিন। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় পাহাড়ি এলাকার মানুষকে তিন থেকে চারগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বেসরকারি গাড়ি ভাড়া করতে হচ্ছে। অনেক সময় গাড়ি জোগাড় করতে দেরি হওয়ায় রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. নাসরিন জেবিন স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা জনগণের সেবক। আমি জনগণকে পর্যাপ্ত সেবা দিতে এখানে এসেছি। আমার দায়িত্বকালে হাসপাতালে অবহেলা, অনিয়ম কিংবা দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ ধরনের কাজে জড়িত থাকে, অভিযোগ পেলে জিরো টলারেন্স নীতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, “উখিয়ার স্বাস্থ্যসেবায় ৪টি অ্যাম্বুলেন্সই ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখবে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও ড্রাইভার সংকটের কারণে বর্তমানে সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি কুতুবদিয়া হেলথ কমপ্লেক্সকে দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটির মধ্যে একটি সচল আছে। বাকি দুটি সচল করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে সিভিল সার্জনের সাথেও আলোচনা হয়েছে।”
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন এ বিষয়ে বলেন, “উখিয়ায় সরকারি অ্যাম্বুলেন্স শিগগিরই সচল করা হবে। ইতিমধ্যে এনজিওর সহযোগিতায় রোগীরা সেবা পাচ্ছেন। তবে আমরা চাই সব সরকারি গাড়িই কাজে লাগুক।”
তবে স্থানীয়রা মনে করছেন, বছরের পর বছর এই আশ্বাস দিয়ে আসা হচ্ছে। বাস্তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যেখানে জীবন বাঁচাতে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান, সেখানে কেন সচল গাড়ি অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকবে? কেন উখিয়ার বরাদ্দকৃত গাড়ি কুতুবদিয়ায় চলে গেল? এসব প্রশ্নের উত্তর স্থানীয়রা আজও পাননি।
একজন অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী মন্তব্য করেন, অ্যাম্বুলেন্স শুধুই গাড়ি নয়, এটি জীবন রক্ষার মাধ্যম। অথচ উখিয়ায় এটিকে ভাগবাটোয়ারার খেলায় পরিণত করা হয়েছে। কেউ দায় নিচ্ছে না, সবাই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
অ্যাম্বুলেন্স সেবা শুধু স্বাস্থ্যখাতের সুবিধা নয়; এটি প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু উখিয়ার মানুষ সেই অধিকার থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত। এর ফলে শুধু অর্থনৈতিক চাপ নয়, অনেক প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে।
স্থানীয়দের মতে, প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ। নিয়মিত মেরামত, পর্যাপ্ত জ্বালানি বরাদ্দ ও ড্রাইভার নিয়োগ নিশ্চিত করা হলে এক সপ্তাহের মধ্যেই সব গাড়ি সচল করা সম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলো—বছরের পর বছর এই সমস্যাকে অবহেলা করা হয়েছে। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়ে।
উখিয়ার অ্যাম্বুলেন্স সংকট কোনো সাধারণ প্রশাসনিক ত্রুটি নয়; এটি রাষ্ট্রীয় অবহেলার নির্মম চিত্র। সরকারি চারটি অ্যাম্বুলেন্স থাকা সত্ত্বেও রোগী যদি তিন থেকে চার হাজার টাকা দিয়ে বেসরকারি গাড়ি ভাড়া করতে বাধ্য হয়, তবে সেটি নাগরিক অধিকার বঞ্চনার দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এখন জরুরি প্রয়োজন—অ্যাম্বুলেন্সগুলো দ্রুত সচল করা, অনিয়মের শিকড় উপড়ে ফেলা এবং স্বাস্থ্যসেবাকে প্রকৃত অর্থে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। অন্যথায় প্রতিটি অকাল মৃত্যুই হয়ে থাকবে প্রশাসনিক ব্যর্থতার এক কালো দাগ।
