পাঁঠা দিয়ে ছাগী প্রজনন করানোর আয়ে চলে সংসার

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:২৮ | অনলাইন সংস্করণ

  নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি

শেরপুরের নকলা উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের মোজার বাজার এলাকার নিরঞ্জন রবি দাস তার লালিত পাঁঠার সেবা করছেন। ছবিটি তোলা হয়েছে সোমবার বিকেলে।

বাংলাদেশে ছাগল ‘গরীবের গাভী’ নামে পরিচিত। দেশে ছাগলের সংখ্যা বাড়াতে হলে সময়মত ছাগীকে প্রজনন ঘটানো জরুরি। কিন্তু সামাজিক ও ধর্মীয় ভুল ধারণার কারণে খামারিরা সহজে পাঁঠা পালন করতে চান না। আবার চাহিদা বেশি থাকায় মর্দা ছাগলকে জন্মের কয়েক দিন পরই খুজা করণের মাধ্যমে খাসি করিয়ে দেয়া হয়। সামাজিক অবজ্ঞা আর নানা কটুকথা উপেক্ষা করে কেউ কেউ পাঁঠা পালন করেন। তাদেরকে সমাজের নিম্নমানের বা নিম্ন বংশের লোক মনে করা হয়। কিন্তু তারা যদি পাঁঠা পালন না করতেন, তাহলে আজ দেশে ছাগলের সংখ্যা বহুগুণ কমে যেতো।

প্রজনন কাজে ভালো পাঁঠার চাহিদা থাকায় কেউ কেউ বাণিজ্যিক ভাবে পাঁঠা লালন-পালনের মাধ্যমে আয়ের নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন। ছাগলের প্রাকৃতিক প্রজননের মধ্যদিয়ে আত্মনির্ভরশীলতার পথ খুঁজে পেয়েছেন তারা। তাতে একদিকে যেমন ছাগল বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে চলছে তাদের সংসারের খরচ।

বাণিজ্যিকভাবে ছাগলের প্রজনন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন মানুষ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—বানেশ্বরদী ইউনিয়নের মোজার বাজার এলাকার প্রয়াত রাজা রাম রবি দাসের ছেলে নিরঞ্জন রবি দাস এবং প্রয়াত বিষু রবি দাসের ছেলে কানাই রবি দাস। একই এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রয়াত আয়াতুল্লাহ কামাড়ের ছেলে মো. উজ্জল মিয়াও রয়েছেন এই পেশায়।

এছাড়া পৌরসভার মাওড়া এলাকার কালারোয়া রবি দাস, মহেশ রবি দাস, ভাঙ্গারু রবি দাস, হীরা রবি দাস, পরিমল রবি দাস ও শ্রী রিতিকা রানী দাস; টালকী ইউনিয়নের দুর্গা রানী দাস; নকলা ইউনিয়নের ছত্রকোনা এলাকার শারীরিক প্রতিবন্ধী নরেশ রবি দাস; চক্কা কান্দার নরেন্দ্র রবি দাস এবং গণপদ্দী ইউনিয়নের বিহাড়ির পাড় এলাকার পবিত্র রবি দাসসহ অনেকেই ছাগল প্রজননকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

এদের পাশাপাশি নকলা ইউনিয়নের ধনাকুশা পশ্চিমপাড়া, গণপদ্দী ইউনিয়নের আদমপুর ও চরঅষ্টধর, চন্দ্রকোনা এবং পাঠাকাটা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার অন্তত অর্ধশত পরিবার বাণিজ্যিকভাবে পাঁঠা লালন-পালনের মাধ্যমে আয়ের নতুন পথ খুঁজে পেয়েছেন। এসব পরিবারের অনেকেই ছাগীর প্রজননের মাধ্যমে আয় করা অর্থেই সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিচ্ছেন, পাশাপাশি চলছে তাদের পুরো সংসারও।

মোজার বাজার এলাকার নিরঞ্জন রবি দাসের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ছাগলের প্রজনন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে তার দুটি বড় পাঁঠা রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি প্রতিদিন গড়ে ২-৩টি ছাগীর প্রজনন ঘটান। প্রতিটি প্রজননের জন্য ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। তবে ছাগীর প্রজননের ঋতু মূলত বছরে ছয় মাস—এই সময় পাঁঠার ব্যাপক চাহিদা থাকে। তখন দৈনিক গড়ে ৪ থেকে ৬টি ছাগীর প্রজনন ঘটানো সম্ভব হয়। এ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়েই তিনি সন্তানদের পড়াশোনাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ মেটান।

তিনি আরও জানান, মোজার বাজার এলাকায় মো. উজ্জল মিয়া এই পেশায় সবচেয়ে পুরোনো ব্যক্তি—প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি পাঁঠার মাধ্যমে প্রজনন ঘটানোর কাজ করছেন। তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে প্রয়াত বিষু রবি দাসের ছেলে কানাই রবি দাসও দুই বছর আগে এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন।

নিরঞ্জন রবি দাস জানান, পাঁঠাকে মাঠে চড়ানো যায় না; বাড়িতে রেখেই লালন-পালন করতে হয়। ফলে প্রতিটি পাঁঠার পেছনে নিয়মিত খরচ করতে হয়। অধিক প্রজননের কারণে পাঁঠার স্বাস্থ্যহানিসহ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য ভালো খাবার ও সঠিক যত্ন অত্যন্ত জরুরি।

তিনি বলেন, প্রতিদিন পাঁঠাকে সবরি কলা, ভুট্টা, গম, ছোলা, খুদি, ভাত ও বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা খাওয়াতে হয়। পাশাপাশি সময়মতো প্রয়োজনীয় ওষুধও দিতে হয়। এতে প্রতিটি পাঁঠার পেছনে দৈনিক খাবার ও যত্ন বাবদ প্রায় ১০০ টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া পাঁঠার জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত ঘর থাকা বাধ্যতামূলক বলেও জানান তিনি।

মাওড়া এলাকার কালারোয়া রবি দাস ও মহেশ রবি দাস জানান, পাঁঠা লালন-পালন ছাড়া তাদের জীবিকার আর কোনো বিকল্প পথ নেই। তারা বলেন, বাড়িতে লালিত পাঁঠাগুলোই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। এক অর্থে, এই পাঁঠাগুলো যেন উপার্জনক্ষম সন্তানের মতো। সন্তান যেমন উপার্জন করে মা-বাবার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়, তেমনি পাঁঠার আয়ে চলছে তাদের সংসার। তাই সন্তানের মতো করেই পাঁঠাগুলোকে লালন-পালন করেন তারা।

তারা জানান, ছোট একটি বাচ্চা পাঁঠা ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকায় কিনতে হয়। এসব পাঁঠা এক বছর পর থেকে প্রজননক্ষম হয়ে উঠে। আর বড় পাঁঠা কিনতে বর্তমানে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগে। শুধু পাঁঠার আয়ে অনেকের সংসার চলেনা। তাই অন্যের বাড়িতে মজুরী খাটতে হয় বা বিকল্প আয়ের পথ বেছে নিতে হয় তাদের। বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে অনেকে সেলুন ব্যবসাকে বেছে নিয়েছেন বলে সরেজমিনে দেখা গেছে।

তবে শুধু পাঁঠার আয়ে সবার সংসার চলে না বলে জানান তারা। অনেক সময় সংসারের খরচ চালাতে বাড়তি আয়ের প্রয়োজন হয়। এজন্য কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে মজুরের কাজ করেন, আবার কেউ কেউ বিকল্প পেশা হিসেবে সেলুন ব্যবসা বেছে নিয়েছেন—এমন চিত্রও সরেজমিনে লক্ষ্য করা গেছে।

ভূরদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ্জ মো. ছায়েদুল হক জানান, তাদের সংস্থার সদস্যরা সবাই কমবেশি পশু-পালি লালন পালনে যুক্ত রয়েছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস নিয়মিতভাবে এসব প্রাণির খোঁজখবর নেন এবং প্রয়োজনীয় ভ্যাক্সিন প্রদান করেন।

তিনি আরও জানান, দেশে প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে সরকারিভাবে গরু ও মহিষের প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু ছাগলের জন্য এখনো কোনো সরকারি প্রজনন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। অথচ ছাগল গরীবদের ‘গাভী’ হিসেবেই পরিচিত। তাই ইউনিয়ন পর্যায়ে ছাগল প্রজনন কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি।

যদিও সরকারিভাবে প্রতিটি ইউনিয়নে ছাগল প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব না, তবুও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রজনন কেন্দ্রগুলোকে আধুনিকায়ন করার জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছেন স্থানীয় প্রাণিবিদ ও অভিজ্ঞরা।

অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীমাতৃক এই দেশটি ছাগল পালনের জন্য খুবই উপযোগী। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে পাঁঠার সংকট। ছাগী প্রজননে সহজলভ্য পাঁঠার সুব্যবস্থা না থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে ছাগলের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গিয়ে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান মঞ্জু জানান, দেশে ছাগলের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত হলো ব্লাক বেঙ্গল। জাতটিকে ভৌগোলিক নিদর্শন (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খামারিরা যমুনাপাড়ি, হরিয়ানা, ব্রিটল, বারবারি, শিরোহীসহ বিভিন্ন জাতের ছাগল পালন করেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ছাগল প্রজনন কেন্দ্রের পাঁঠার স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হয়। পাশাপাশি, কৃষক ও খামারীদের পশু-পাখির যেকোনো সমস্যায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।

তিনি আরও জানান, দিনদিন উপজেলায় হাঁস-মুরগি, গরু ও ছাগলের খামার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এসব প্রাণিকে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে কৃষক ও খামারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে জানান এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।