চুয়াডাঙ্গায় তীব্র সারসংকট, সিন্ডিকেটে বিপাকে কৃষক

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:১৫ | অনলাইন সংস্করণ

  শরীফ উদ্দীন, চুয়াডাঙ্গা

আউশ মৌসুমেও চুয়াডাঙ্গায় দেখা দিয়েছে তীব্র সারের সংকট। জেলার চারটি উপজেলায় ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি—এই তিন ধরনের সার সরকারি ডিলার পয়েন্টে মিলছে না। অথচ একই সার খুচরা দোকানে পাওয়া যাচ্ছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দামে।

প্রান্তিক কৃষকরা বলছেন, সরকারি ডিলারদের কাছ থেকে যে দামে সার পাওয়ার কথা, বাস্তবে তা মিলছে না। কিন্তু বাজারে গেলে পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, তবে দ্বিগুণ দামে। তাদের অভিযোগ, একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কৃষকদের জিম্মি করছে। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ একাধিকবার বিসিআইসি ও বিএডিসি অনুমোদিত ডিলারদের সঙ্গে বৈঠক করলেও সংকট কাটেনি।

মাঠ ঘুরে দেখা যায়, ধানের বীজতলা, পাট, পেঁপে ও আগাম শীতকালীন সবজি চাষে কৃষকের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। এ সময় ইউরিয়া, টিএসপি ও ডিএপি সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় জোগান একেবারেই অপ্রতুল।

গাড়াবাড়িয়া গ্রামের কৃষক এনামুল হক বলেন, ‘ভোটার আইডি দেখিয়ে ডিলারের ঘর থেকে মাত্র ১০-২০ কেজি সার মিলছে। অথচ আমার দরকার ২০০ কেজি।’ একই গ্রামের কৃষক আকাশ হোসেনের অভিযোগ, ‘ডিলারের কাছে গেলে পাওয়া যাচ্ছে না। খুচরা দোকানে গেলে মিলছে, কিন্তু দাম দ্বিগুণ।’ বেলগাছি ইউনিয়নের কৃষক মামুন হোসেন বলেন, ‘১ হাজার ৩৫০ টাকার সার কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, আমরা দিশেহারা।’

আলমডাঙ্গার কয়রাডাঙ্গা গ্রামের সরোয়ার আলম বলেন, ‘যখন সারের দরকার, তখন না পেলে ফসল ভালো হয় না। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দামে কিনছি।’ আলুকদিয়া গ্রামের কৃষক রিপন আলীর অভিযোগ, ‘মৌসুমে চাহিদা বাড়লেই অসাধু ব্যবসায়ীরা গুদামে সার মজুত করে সংকট তৈরি করে।’

অভিযোগের জবাবে আলুকদিয়া বাজারের বিসিআইসি অনুমোদিত ডিলার বিশ্বাস ট্রেডার্স-এর পক্ষে শাওন বিশ্বাস বলেন, ‘নন-ইউরিয়া সারের সরবরাহ কম। সবাই একসঙ্গে চাইছেন, তাই অল্প অল্প করে দিতে হচ্ছে।’

ভালাইপুর বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘জেলার বাইরে থেকে সার এনে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। খরচ বেশি, তাই দামও বাড়তি।’ একই বাজারের বিক্রেতা মিন্টু আলী বলেন, ‘বস্তাপ্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আবার অনেক সময় দূর থেকে আনতে হয়, সেটাও বাড়তি ব্যয়।’

চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, জেলায় মোট আবাদি জমি ৯৪ হাজার ২০ হেক্টর। এখানে বিসিআইসি অনুমোদিত ৫০টি এবং বিএডিসি অনুমোদিত ৯৩টি ডিলার রয়েছে। চলতি মৌসুমে সার চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার টন।

জুলাই মাসে ইউরিয়া সারের বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৭১৩ টন, যার মধ্যে উত্তোলন হয়েছে মাত্র ৯৬০ টন। মজুত আছে ২ হাজার ৫৯৪ টন। জুন মাসে টিএসপির বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২৮৯ টন, মজুত রয়েছে ৪১৩ টন। ডিএপি সারের বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ১৮৪ টন, মজুত রয়েছে ৮৬১ টন। এমওপি সারের বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৫৫ টন, উত্তোলন হয়নি ২১৭ টন, তবে মজুত রয়েছে ১ হাজার ২৯৮ টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, ‘সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকিমূল্যে সার সরবরাহ করছে। কেউ যদি কারসাজি বা সিন্ডিকেট করে, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা সারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছি।’

জেলা প্রশাসক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘তথ্য অনুযায়ী জেলায় সারের ঘাটতি নেই। কিন্তু কোথায় সার আছে, কে উত্তোলন করছে, কোথায় যাচ্ছে—সব মনিটর করতে হবে। অভিযোগ পেলে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তামাক চাষিরা সরকারি ভর্তুকিমূলক সার পাওয়ার যোগ্য নন। চুয়াডাঙ্গার দুটি তামাক কোম্পানির মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে সেই অনুযায়ী সার বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে মাছচাষিদের ক্ষেত্রেও মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে চাহিদা নির্ধারণ করতে হবে।’

জেলা প্রশাসক হুঁশিয়ারি দিয়ে আরও বলেন, ‘গুদামে সার থাকা সত্ত্বেও কেউ যেন সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে না পারে। প্রশাসন সার পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’