নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহ রূপে ডেঙ্গু: বাড়ছে মৃত্যুর ঝুঁকি

প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১:৫২ | অনলাইন সংস্করণ

  মোশতাক আহমেদ শাওন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু রোগ মহামারীর সীমা ছাড়িয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। শহর ও শহরতলীর ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী, খোদ সরকারি দু’টি হাসপাতালে মশার উৎপাত দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে প্রচণ্ড গরমে রোগীরা শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছেন।

গত এক মাসে শহরের দেওভোগ, লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়া, নন্দীপাড়া, জিউসপুকুরপাড়ের ভূঁইয়ারবাগ এলাকায় স্কুলছাত্রী ও অভিভাবকসহ কমপক্ষে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুজ্বরে। শহরতলীর পশ্চিম দেওভোগ বাংলাবাজার, কাশীপুর, মাসদাইর, ভোলাইল ও বারৈভোগ এলাকায় প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হচ্ছে।

শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষা এই শিল্পনগরীতে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের করিডরগুলো রোগী-ভর্তি হয়ে গেছে। শহরের দু’টি হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগী সামলাতে পারছে না। অনেক রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা মহাখালীতে ডিএনসিসি ডেঙ্গু হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে। প্লাটিলেট কমে গেলে রোগীদের ঢাকায় নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

দেওভোগ লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়ার বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন অঞ্জলি সাহা। তাঁর ১৪ বছরের মেয়ে অনামিকা সাহা ক্লাস এইটে পড়ত। গত ৭ সেপ্টেম্বর তাকে জ্বর নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল ৩০০ শয্যা হাসপাতালে। প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকায় ডাক্তাররা তাকে ঢাকায় রেফার করেন। কিন্তু ঢাকা নেওয়ার আগেই অনামিকা মারা যান।

নন্দীপাড়ার জহির উদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে আশিক (১৯)ও ডেঙ্গুতে মারা যান। তাঁর বাবা জানান, “আমরা ভেবেছিলাম জ্বর হয়েছে, দুই দিন পর রক্ত পড়তে শুরু করল। হাসপাতাল বলল প্লাটিলেট নামছে। ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতে খুঁজতে শেষ হয়ে গেল।”

একইভাবে ভূঁইয়ারবাগ থেকে অন্তত আরও পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেনারেল হাসপাতাল (ভিক্টোরিয়া) নারায়ণগঞ্জের করিডরের একপাশে স্ট্রেচারে শুয়ে আছেন রোগী। কেউ স্যালাইন নিচ্ছেন, কেউ শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছেন। বেডে জায়গা না থাকায় অনেককে মেঝেতেই শোয়ানো হয়েছে।

সিভিল সার্জন ডা. এ এফ এম মুশিউর রহমান জানান, নারায়ণগঞ্জে কোনো হাসপাতালে প্লাটিলেট কাউন্ট বা সেপারেশন মেশিন নেই। এ কারণে জটিল অবস্থার রোগীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। প্রতিদিন সদর হাসপাতাল ও ৩০০ শয্যা হাসপাতালে অন্তত ১০০–১৫০ রোগী ভর্তি হচ্ছে। বেড সীমিত হওয়ায় অনেককে ঢাকায় পাঠানো বাধ্যতামূলক।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর জটিল অবস্থায় রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়, যা রক্তক্ষরণ ঝুঁকি বাড়ায়। প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন একমাত্র কার্যকর সমাধান। ঢাকায় কয়েকটি হাসপাতালে এই সুবিধা থাকলেও নারায়ণগঞ্জে একটিও নেই। প্রতিদিন অন্তত ১৫–২০ রোগীকে মেশিন না থাকায় ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, একটি আধুনিক প্লাটিলেট সেপারেশন মেশিনের মূল্য প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। বাজেট সীমাবদ্ধতা ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এটি এখনও কেনা হয়নি। জেলা সিভিল সার্জন দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বারবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, প্রক্রিয়া চলছে।”

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, “ডেঙ্গু মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি প্লাটিলেট সেপারেশন মেশিনের ব্যবস্থা করা হবে।”