অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাহীনতায় পর্যটক কমছে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ
জহিরুল ইসলাম মিশু, সিলেট

পাহাড়, ঝরনা, নদী, হাওর, চা বাগান, অরণ্য জলারবন নিয়ে প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি সিলেট। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য আর বৈচিত্রতার কারণে পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান হচ্ছে সিলেট। ইতোমধ্যে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সাদাপাথর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছে। ধলাই নদীর ধবধবে পানি আর সাদা পাথরে মন ছুঁয়ে যায় পর্যটকদের। এছাড়া পৃথিবীর মিঠা পানির ২২টি জলাবনের একটি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল জলাবন। এই জলাবন পর্যটকদের কাছে সবসময়ই রোমাঞ্চকর। বনের ভিতরে নৌকার ভ্রমণের সময় নানা প্রজাতির সাপ, প্রাণী ও বিভিন্ন পাখিদের মধুর ডাক রোমাঞ্চিত করে পর্যটকদের। এছাড়া একই উপজেলার বিছনাকান্দি, জাফলং পর্যটকদের বিমোহিত করে। এসব পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অসংখ্য পর্যটক আসেন সিলেটে। এছাড়াও হয়রত শাহজালাল রহ. ও হযরত শাহপরাণ রহ. এর মাজার এবং চা বাগানের সবুজ দৃশ্য মন কাড়ে পর্যটকদের। সম্প্রতি সাদাপাথর সহ কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্রে পাথর ও বালু লুটের ঘটনায় দেশ ও বিদেশে আলোচনার জন্ম দেয়। এসব কর্মকাণ্ডের পর সিলেটে কমেছে পর্যটকদের আগমন। এছাড়াও অনুন্নত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা, জরাজীর্ণ সড়ক, নিরাপত্তাহীনতা, অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, প্রচারের অভাব ও দক্ষ জনশক্তি না থাকা সহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পর্যটন বিকাশে অন্যতম বাধা বলে মনে করেন এখাতের সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকায় সিলেটে অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে দীর্ঘ যানজটের কারণে সিলেট পৌঁছাতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পর্যটকদের। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে পর্যটকদের আনাগোনা ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এছাড়া অবাধে বালু ও পাথর লুটপাটে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্যহানীর কারণে কমছে পর্যটক।
সিলেট থেকে সড়কপথে কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে ভোলাগঞ্জ ১০নম্বর পর্যটন বাজারে গিয়ে নামতে হয়। তারপর নৌকাযোগে যেতে হয় এক কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিয়ে সাদাপাথর। একজন হোন কিংবা আটজন হোন সাদাপাথর স্পটে যেতে হয় ইঞ্জিন নৌকাযোগে। এখানেও রয়েছে সিন্ডিকেটের দাপট। নৌকা দিয়ে আসা যাওয়া করতে হলে একজন হলে ৮শ’ টাকা দিতে হয় এমনকি ৮ জন হলেও একই টাকা দিতে হয়। বেশি টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া করতে হয় বলে অনেকেই স্পটে যেতে পারেন না। স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক যদি স্থানীয় পদ্ধতিতে নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে সাদা পাথরে পর্যটকদের সংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পেতো এবং একা ভ্রমণে অনেকেই আগ্রহী হতেন। দেশের জনপ্রিয় এই পর্যটন কেন্দ্রে নেই কোনো বাথরুম কিংবা ভেজা কাপড় পরিবর্তনের নির্দিষ্ট রুম, নেই বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। নেই কোনো মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেল ও ভালো মানের খাবারের রেস্তোরাঁ। গত চার বছর আগে সাদা পাথরে একটি বাথরুম করা হয়েছিল যা গত বন্যায় পাহাড়ি ঢলের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। পর্যটকদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নিরাপত্তার সমস্যা রয়েছে। শুধু টাকা নিয়ে রশিদ দিয়েই দায় শেষ করেন ইজারাদাররা। সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি পার্কিংয়ের। অনেক সময় মাইকিং করে নিজ দায়িত্বে গাড়ি রাখার ঘোষণা দেন তারা। এদিকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সাদাপাথরে পার্কিং এলাকা থেকে এক পর্যটকের প্রাইভেটকার চুরি হয়ে যায়। ভোক্তভোগী এই পর্যটক জানান, সকাল ৭টার দিকে তারা একটি প্রিমিও প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ-২১৩৮৩৮) নিয়ে সাদাপাথর ভ্রমণে আসেন গাড়িটি তারা পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট জায়গা পার্কিং করে চালকসহ সাদাপাথর এলাকায় ঘুরতে যান, প্রায় চার ঘন্টা পর সকাল ১১টায় ফিরে এসে দেখেন গাড়িটি আর সেখানে নেই। এঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এখানও পর্যন্ত গাড়ি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও পর্যটকদের গাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র প্রায়ই চুরি হয়ে থাকে।
সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালি বিভাগের প্রভাষক মো. আব্দুল হালিম বলেন, সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রে কোন বিশ্রামাগার ও ওয়াশরুম নেই। এতে পর্যটকরা এসব স্থানে এসে বিপাকে পড়েন। কেবল পর্যটন এলাকায় নয়, ওইসব স্থানে যাওয়ার পথেও ওয়াশরুম নির্মাণ করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নেই। ফলে পর্যটকরা অনেক সময় পর্যটন এলাকা নোংরা করে ফেলেন। পর্যটন শিল্পের বিকাশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও জরুরি।
সিলেটের অন্যতম আরো দুটি পর্যটন কেন্দ্র হলো বিছনাকান্দি ও রাতারগুল জলারবন। এই দুটি স্থানে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সড়কপথ। বিগত কয়েক বছর থেকে এই দুই স্থানে যাতায়াতে সড়কের অবস্থা বেহাল দশা। পর্যটন স্পট বিছনাকান্দির দুরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এই দূরত্বের গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গবীর রোড থেকে হাদারপাড় পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারের সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক ও খানাখন্দে ভরা। বিগত বন্যায় সড়কের পিচ উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হলেও এখনো পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার হয়নি।
জলারবন খ্যাত রাতারগুলের দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই সড়কের পাঁচ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। এছাড়াও এই সড়কের চাঁনপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক হলো কাঁচা রাস্তার। বৃষ্টির দিনে পর্যটকদের যাতায়াতে চরম সমস্যায় সম্মুখীন হতে হয়। এসব এলাকা যাতায়াতের একমাত্র বাহন হচ্ছে সিএনজি-অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত টমটম। যার ফলে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এই কারণে পর্যটকরা এই দুই স্থানে ভ্রমণে অনীহা প্রকাশ করছেন।
এ ব্যাপারে সিলেট এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. হাবিবুল্লাহ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এই রাস্তা সংস্কারের জন্য আমার ইমার্জেন্সি মেইটেনেন্স এর আওতায় কাজ করার জন্য চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি বরাদ্ধ পেলে আগামী এক মাসের মধ্যে খানাখন্দগুলো ভরাট করে দেবো। এতে যাতায়াতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসবে। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো রাস্তা নতুনভাবে মেরামত করা হবে।
এদিকে সিলেটের জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি, লালাখালে বেড়াতে এসে প্রায়শই পানিতে ডুবে মারা যান পর্যটকরা। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ও স্রোত বেড়ে যাওয়ায় পানিতে ডুবে প্রাণহানি বেশি ঘটে। বার বার এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু জন্য সংশ্লিষ্টরা পর্যটকদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করছেন। অপরদিকে, পর্যটকদের অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাই প্রাণহানি বাড়ছে। সরেজমিনে সিলেটের কয়েকটি পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি সাইনবোর্ড টাঙানো ছাড়া সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তায় আর কোন উদ্যোগ নেই। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিত তেমন লক্ষ্য করা যায় না।
এ ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মতিউর রহমান দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, সিলেটে আমাদের সাতটি জোন আছে। এমনিতেই আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। আমার ভাড়াবাসা নিয়েই অফিস পরিচালনা করছি। পর্যটন স্পটগুলোতে অস্থায়ী হেল্প ডেস্ক বসিয়ে সেবা প্রদানের চেষ্টা করছি। কেউ কোনো অভিযোগ করলে আমরা আইনগত সেবা প্রদান করি। পর্যটকদের সেবার মান আরো উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছি।
এদিকে, সিলেটের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হতে পারে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
