মিশ্র বাগানে বস্তায় আদা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ২১:২৯ | অনলাইন সংস্করণ

  নকলা (শেরপুর) প্রতিনিধি

শেরপুরের নকলা উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বানেশ্বরদী দক্ষিণ (কান্দাপাড়া) এলাকার মোস্তাক আনোয়ার রাকিব বস্তায় চাষ করা আদা গাছের সেবা করছেন।

বহুবর্ষজীবী মিশ্র বাগানে নামমাত্র শ্রমে ও অল্প খরচে বস্তায় আদা চাষ করে বাড়তি আয়ের পথ খোঁজে পেয়েছেন শেরপুরের নকলা উপজেলার অনেকে। এমন একজন চাষী হলেন, উপজেলার বানেশ্বরদী ইউনিয়নের বানেশ্বরদী দক্ষিণ (কান্দাপাড়া) এলাকার মোস্তাক আনোয়ার রাকিব।

রাকিব তার বাড়ির পাশের মিশ্র ফল বাগানে গাছের ফাঁকে ২ হাজার ৫০০ বস্তায় আদা চাষ করে এলাকাবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। গাছের ফাঁকে অন্যকোনো আবাদ করা সম্ভব না হলেও, বস্তায় আদা চাষের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের পথ খোঁজে পাওয়ায় এই মসলা জাতীয় বর্ষজীবী ফসলে ঝুঁকছেন কৃষক।

আগে যেকোন গাছের বাগানে আগাছা জন্মাতো, অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হতো, সেখানে এখন বস্তায় আদা চাষ করা হচ্ছে। আবাদি জমিতে আদা চাষ করলে তাতে মাটি বাহিত রোগের কারণে আশানুরূপ ফলন পওয়া যেতো না। তাই বস্তায় চাষ পদ্ধতি দিন দিন নকলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

রাকিব জানান, তার মিশ্র ফল বাগানের গাছের ফাঁকে ২,৫০০ বস্তায় আদা রোপণ করতে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়েছে। এরমধ্যে, প্রতিটি বস্তার দাম গড়ে ৯ টাকা, প্রতি মণ ৭ হাজার টাকা হারে ৭ মণ বীজ আদা, ৩,৫০০ হাজার টাকার ছাই, ৩ হাজার টাকার গোবর, মাটি ৬ ট্রাক, বিভিন্ন রাসায়নিক সার ৬ হাজার ৫০০ টাকার ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ২৫ হাজার থেকে ২৮ হাজার টাকা ও ভেড়া দেওয়া বাবাদ ৫,০০০ টাকা উল্লেখ করার মতো। এক বছর মেয়াদী এই ফসলে লাভবান হবেন বলে তিনি জানান।

তিনি আরো জানান, বহুবর্ষজীবী নতুন কোন বাগান করলে, গাছ বড় হতে কয়েক বছর সময় লাগে। এতে গাছের ফাঁকে বেশ জায়গা পতিত থাকে। এসব পতিত জমিতে বিভিন্ন শাক-সবজি, আদা, হলুদ, মরিচসহ স্বল্পকালীন বিভিন্ন ফসল আবাদ করা যায়। এতে গাছের বাগানের কোন ক্ষতি হয়না, বরং গাছের ফাঁকে শাক-সবজিসহ স্বল্পকালীন বিভিন্ন ফসল আবাদ করলে বাড়তি আয় পাওয়া যায়। এছাড়া গাছের ফাঁকের পতিত জমিতে স্বল্পকালীন আবাদ করায় গাছের জন্য বাড়তি কোন সেবাযত্ন করতে হয়না। এসব বিবেচনায় রাকিব তার বাগানে বস্তায় আদার আবাদ করেছেন।

মোস্তাক আনোয়ার রাকিবের বাগানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তার মিশ্র ফল বাগানে আম, পেয়ারা, লটকন, মালটা ও পেঁপেসহ সবজির মধ্যে বেগুন, মরিচ, কুমড়ার আবাদ করেছেন। এছাড়া বাগানের বাহির দিয়ে সুপাড়ি ও লেবু গাছ রোপন করেছেন। আর এসব গাছের ফাঁকে ২,৫০০ বস্তায় আদা রোপন করেছেন। প্রতিটি বস্তার আদা গাছ পাতাসহ সাড়ে ৩ ফুট থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়েছে। এখন আবাদের মাঝামাঝি সময় হলেও আদার চাপে মাটি ফাঁটা শুরু হয়েছে। এতে স্থানীয় কৃষকরা মনে করছেন ব্যাপক ফলন হবে। রাকিব আশা করছেন প্রতি বস্তায় ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি করে আদা উৎপাদন হবে। তার ২,৫০০ বস্তা আদার আবাদ থেকে সব খরচ বাদে অর্ধলক্ষ টাকা লাভ থাকবে; যা পুরোটাই বাড়তি আয়।

স্থানীয় অনেক কৃষক জানান, গাছের বাগানে সাথী ফসল হিসেবে আদার আবাদ বেশি হয়। আর তাইতো বোনাস ফসল বা সাথী ফসল হিসেবে কৃষকরা আদা চাষ করেন। কয়েক বছর ধরে উপজেলার চন্দ্রকোনা, চরঅষ্টধর, পাঠাকাটা, বানেশ্বরদী ও গৌড়দ্বার ইউনিয়নসহ বেশ কিছু এলাকায় মিশ্র গাছের বাগানে আদা চাষ করা হচ্ছে। তবে এবার কৃষকের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আদার আবাদ কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে অর্জন বেড়েছে।

ভ‚রদী খন্দকার পাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলহাজ মো. ছায়েদুল হক জানান, তাদের গাছের বাগানের ফাঁকের জায়গা পতিত ফেলে রাখা হতো। কৃষি বিভাগের পরামর্শে কয়েক বছর ধরে গাছের ফাঁকে বস্তায় আদা ও হলুদ চাষ শুরু করেছেন। প্রথমে নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য চাষ করলেও এখন তা বাণিজ্যিকভাবে করা হচ্ছে। সামান্য পরিশ্রম ও অল্প খরচে অধিক লাভ পাওয়ায় যেকোন বাগানে আদা চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া অনাবাদি পতিত জমি ও বসত বাড়ির আঙিনায় বস্তায় আদা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। ফলে কৃষকের বাড়ির আঙিনায়, পুকুর পাড়ে, রাস্তার দুই পাশে ও পরিত্যক্ত পতিত জমিতে এখন ফসল ফলানোর ভূমি হয়ে উঠেছে। বাড়ছে কৃষি উৎপাদন, সমৃদ্ধ হচ্ছে কৃষি অর্থনীতি; এমনটাই মনে করছেন তিনি।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, আমরা মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সবাই নিয়মিত কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। তাদেরকে বাড়ির আঙিনায়, সুপারি বা যেকোন বর্ষজীবী গাছের বাগানে, পুকুর পাড়ে, আলোছায়া ঘেরা উঁচু জমিতে, ফলের বা কাঠের বাগানের নিচে বা পতিত জমিতে বস্তায় মাটি ভরে আদা চাষে আগ্রহী করছি। এতে কয়েকগুণ বেশি লাভ পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে চাষ করেল আবাদি জমির প্রয়োজন হয়না, অনাবাদি বা পতিত জায়গায় সহজে আদা চাষ করা সম্ভব।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় বস্তায় আদা চাষের জন্য মোট ২১টি প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। ্এরমধ্যে, পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ২০টি এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় বস্তায় আদা চাষের জন্য একটি প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে।

পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি প্রদর্শনীর জন্য কৃষককে ২ কেজি করে বীজ আদা প্রদান করা হয়েছে। এতে মোট ৪০ কেজি বীজ বিতরণ করা হয়। প্রতি বস্তায় সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম হারে বীজ দিতে পরামর্শ প্রদান করেছেন মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাগণ। এ হিসেব মতে পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপন প্রকল্পের আওতায় এবছর উপজেলায় ৪০০টি বস্তায় আদা চাষ করা হয়েছে। এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় আরো একটি বড় স্থাপন করা হয়েছে। ওই প্রদর্শনীর জন্য কৃষককে ৮০ কেজি বীজ আদা প্রদান করা হয়। যাদিয়ে ৮০০টি বস্তায় আদা চাষ করা হয়েছে। তাছাড়া কৃষকরা নিজ উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় প্রায় ২২ হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন। সব মিলিয়ে উপজেলায় ৬৬ হেক্টর জমিতে আদা চাষ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালীন মেহেদী। তবে উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৭০ হেক্টর থেকে ৮০ হেক্টর জমিতে আদা চাষ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, এই উপজেলার মাটি আদা চাষের জন্য উপযোগী। আদা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ভাবে কৃষি প্রণোদনা বা প্রদর্শনী বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং উন্নত জাতের বীজ বিতরণের মাধ্যমে আগামীতে আদার আবাদ ও চাষীর সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। বস্তায় ও পতিত জমিতে আদা চাষ করে যেকেউ লাভবান হতে পারেন, হতে পারেন স্বাবলম্বী; এমনটাই মনে করেন কৃষিবিদ শাহরিয়ার মুরসালিন মেহেদী।