পাবনায় ১৬৬ ইটভাটার মধ্যে ১৪১টি অবৈধ, পরিবেশ ও ফসল বিপন্ন

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

  পাবনা প্রতিনিধি

পাবনায় কৃষি জমি ও আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে একের পর এক গড়ে উঠছে ইটভাটা। ভাটায় কয়লার পরিবর্তে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ব্যবহার করা হচ্ছে টিনের চিমনি। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে বিঘ্নিত হচ্ছে কৃষি ফসল উৎপাদন। জেলার ৯টি উপজেলায় ১৬৬ ইটভাটার মধ্যে অবৈধভাবে চলছে ১৪০টি ভাটা।

পাবনা জেলা প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১৬৬টি ইটভাটা নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু মাত্র ২৫টি ইটভাটা নিবন্ধন নবায়ন করেছে। বাকীগুলো নিবন্ধন ছাড়া অবৈধভাবে চলছে।

অপরদিকে পাবনা ইটভাটা মালিক সমিতির একটি সূত্র জানায়, জেলার ৯ উপজেলায় দুই শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। কিছু ইটভাটা কোন প্রকার নিবন্ধন ও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে। অনেক ইটভাটায় ছোট টিনের ড্রাম চিমনি ব্যবহার ও কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর পাবনা কার্যালয় জেলায় ৯২টি অবৈধ ইটভাটা শনাক্ত করেছে। এসব ইটভাটায় ১২০ ফুট চিমনিতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে পাবনা সদর উপজেলায় ৩৯টি, ঈশ্বরদীতে ৪৬টি, ফরিদপুরে ৬টি এবং সাথিয়ায় ১টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার মধ্যে ১৩টিতে কাঠ ব্যবহারের জন্য করাতকল বসানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

মঙ্গলবার ও সোমবার সরেজমিন পাবনা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার হিমায়েতপুর ইউনিয়নের চর ঘোষপুর, বাঙ্গাবাড়ী ও ভবানীপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠের মধ্যে একের পর এক ইটভাটা। ছোট-বড় চিমনিতে জ্বলছে ভাটাগুলো। অধিকাংশ ভাটাতেই পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কিছু ভাটায় করাতকল বসিয়ে কাঠ কাটা হচ্ছে। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে আছে চারপাশ। ধোয়ায় আশপাশের গাছপালা ও ফসলের মাঠ বিবর্ণ রূপ নিয়েছে।

চর ঘোষপুর গ্রামের বাসিন্দা ফরিদ শেখ জানান, তিনটি গ্রামে ৫২টি ইটভাটা থাকায় এলাকাটি ‘৫২ ভাটা’ নামে পরিচিত। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই একযোগে এসব ইটভাটায় ইট পোড়ানো শুরু হয়। প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস ইট পোড়ানো চলে। অধিকাংশ ইটভাটা কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ায়। ফলে ইটপোড়ানোর পুরো মৌসুম এলাকাটি কালো ধোঁয়ায় ঢেকে থাকে।

ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কয়লার চেয়ে কাঠ পোড়ানো লাভজনক। একারনে ভাটা মালিকরা কাঠ পোড়ায়। কয়লা পোড়ালে ১ হাজার ইট তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা, যেখানে কাঠ পোড়ালে খরচ হয় ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। ফলে অধিকাংশ ভাটামালিক কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ান। বড় বড় গাছ ইট ভাটায় এনে করাতকলে কেটে নেওয়া হয়। ইটভাটাতেই করাতকল বসানো হয়েছে।

চরবাঙ্গাবাড়ী গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ইটভাটাগুলিতে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোতে কালো ধোঁয়া হচ্ছে। এতে গ্রামের বাসিন্দাদের বসবাসে এবং কৃষি ফসলের উৎপাদনে ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই।

পাবনা জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আবুল কাশেম বলেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী জেলায় দুইশতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩২টি ইটভাটা কয়লা ব্যবহার করে। বাকীগুলো কাঠ পোড়ায়। বহু ইটভাটা নিবন্ধন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া চলে। এ বিষয়ে প্রশাসন আইনগত পদক্ষেপ নিলে আমাদের কোন আপত্তি নেই।

পাবনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী তারিকুর রহমান বলেন, ইট তৈরির নিয়ম অনুযায়ী জ্বালানি হিসাবে কাঠ ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর পরেও বেশিরভাগ ইটভাটা বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে কাঠ পোড়াচ্ছে। অন্যদিকে করাতকল বসানোর জন্য বন বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু ভাটা মালিকরা কাঠ কাটার সুবিধার্থে অবৈধভাবে ইটভাটায় করাতকল বসাচ্ছেন। অচিরেই আমরা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ইটভাটা গুলোতে অভিযান পরিচালনা করবো।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ইট তৈরির জন্য ফসলী জমি কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।

পরিবেশ অধিদপ্তর পাবনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল গফুর বলেন, অবৈধ ইটভাটা ও কাঠ পোড়ানোর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। সার্বিক বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা এলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এব্যাপারে পাবনার জেলা প্রশাসক শাহেদ মোস্তাফা বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় ইটভাটাগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। যত্রতত্র ইটভাটার কারণে পরিবেশ ও কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।