রংপুরে অবৈধ ইটভাটা ৭৩৪টি: কয়লার ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত পরিবেশ

প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ

  রংপুর ব্যুরো

রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় প্রায় এক হাজার ইটভাটা প্রায় ২০ হাজার একরের বেশি জমি গিলে খেয়েছে। এসব ইটভাটার অর্ধেকেরও বেশি অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা পুড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংস করছে এসব ভাটা। কয়লার কালো ধোঁয়ায় পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি হলেও বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে।

তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, অবৈধ ইটভাটা বন্ধে তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

রংপুর পরিবেশ অফিস সূত্রে জানা গেছে, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়—এই ৮ জেলায় মোট ৯৩৬টি ইটভাটা রয়েছে। এর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ইটভাটাই অনুমোদন ছাড়াই সরকারি বিধিবিধান লঙ্ঘন করে দেদারছে অবৈধভাবে ইট উৎপাদন করছে। জনবসতি, আবাসিক এলাকা, ফসলিজমি, এমনকি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের কাছেও ভাটা স্থাপন করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধভাবে ইট উৎপাদনের ফলে ব্যাপক দূষণ ছড়াচ্ছে।

রংপুর বিভাগে প্রতিমৌসুমে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা পুড়ে প্রস্তুত হচ্ছে ৫–৬ শ’ কোটি পিস ইট। ভাটার কালো ধোঁয়া থেকে নিঃসৃত কার্বনডাইঅক্সাইড পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মানবদেহে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। কোথাও কোথাও নির্বিচারে ভাটা স্থাপনে প্রতিবছর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে।

### **পীরগাছায় ১৭ একর ধানক্ষেত ঝলসে গেছে**

রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ঝলসে গেছে ১৭ একর জমির ধানক্ষেত। এমএসবি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় প্রায় ৩০ জন কৃষকের জমির ধান চিটা হয়ে গেছে। অন্য অনেক জমিতে ধানগাছ জ্বলে কালো হয়ে শুকিয়ে গেছে। এতে করে কেউ কেউ আইলে বসে বিলাপ করছেন, কেউবা বাকি ধান বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে রংপুর জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

পীরগাছার অন্নদানগর ইউনিয়নের বামন সর্দার গ্রামের ইটভাটার উত্তর পাশের জমিগুলোতে এ ক্ষতি হয়। এতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। এছাড়া স্থানীয়দের অভিযোগ—গত পাঁচ বছর ধরে ইটভাটার কারণে ওই এলাকার গাছপালায় ফল ধরছে না।

সূত্র মতে, রংপুর বিভাগের ৯৩৬টি ভাটার মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র রয়েছে মাত্র ২০২টির। অবৈধ আছে ৭৩৪টি। মালিকরা কোনো অনুমোদন ছাড়াই পেশিশক্তির জোরে ভাটা চালাচ্ছেন।

আরও জানা গেছে, একটি ইটভাটায় গড়ে ৬ থেকে ১০ একর জমি লাগে। সেই হিসেবে রংপুর অঞ্চলের ভাটাগুলো প্রায় ২০ হাজার একর জমি দখল করে ফেলেছে। প্রতি মৌসুমে একটি ইটভাটা গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ পিস ইট উৎপাদন করে। একটি ভাটায় ৭০০ থেকে ৮০০ মেট্রিক টন কয়লা লাগে। ফলে প্রতি মৌসুমে ১৫–১৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা পুড়ে যায়। এই কালো ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তবুও কার্যকর ব্যবস্থা এখনো নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মালিক সমিতির দাবি

রংপুর জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম আজিজুল হক বলেন, রংপুর বিভাগে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে। এসব কাজে রংপুরের ভাটা থেকে বিপুল পরিমাণ ইট স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে উন্নয়ন ব্যয় কমছে। তিনি বলেন, লাখ লাখ শ্রমিক ইটশিল্পের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বিভিন্ন সময় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযানের নামে জেল-জরিমানা করছে। এটি বন্ধ না হলে ঈদের পর বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মত

মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলন ‘মাপা’র কেন্দ্রীয় প্রধান নির্বাহী, রংপুরের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট মুনীর চৌধুরী বলেন, রংপুর বিভাগের ইটভাটাগুলো আইন মেনে চলছে না। মালিকরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইট উৎপাদন করছে। এতে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে।

প্রশাসনের অবস্থান

রংপুরের জেলা প্রশাসক এনামুল হাবিব বলেন, জেলায় ২৪০টি ইটভাটা রয়েছে, যার মধ্যে ১৭২টি পরিবেশগত লাইসেন্স ছাড়াই অবৈধভাবে উৎপাদন করছে। এতে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। তিনি জানান, উচ্চ আদালতের নির্দেশে অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে অভিযান চলছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর বিভাগীয় পরিচালক নূর আলম বলেন, বিভাগে বৈধ ইটভাটা ২০২টি, অবৈধ ৭৩৪টি। এ বছর বিএসটিআইয়ের সহযোগিতায় নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে চারটি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। প্রতিটিতে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অবৈধ ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।