১০ মাস পর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে সেন্টমার্টিনে

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪৬ | অনলাইন সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার অফিস

বুধবার বেলা ২টা। হালকা রোদে ঝিলমিল করছে, দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিন। প্রকৃতি যেন সেখানে আলাদাভাবে সেজেছে। সবখানে উচ্ছ্বাস। দীর্ঘ ১০ মাস পর দ্বীপে বাজল পর্যটকবাহী জাহাজের হুইসেল, আবারও পর্যটকে মুখর হলো বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত এই দ্বীপ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন স্থানীয় বাসিন্দারা, আর আনন্দ-উৎফুল্ল দেশের নানাপ্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা। দ্বীপের বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ সবখানে আবারও ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। পর্যটকদের হাসি-আনন্দে মুখরিত সৈকত। দীর্ঘদিন পর ব্যস্ত হয়ে উঠেছে প্রবাল দ্বীপ। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘দ্বীপে মানুষ এলে আমাদের ঘরেও আলো জ্বলে’।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, বুধবার তৃতীয় দিনে চারটি জাহাজে করে ১৩৯৬ জন পর্যটক সেন্টমার্টিনে গেছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মীর আহমেদ, যিনি গত কয়েক মাস ধরে পর্যটন বন্ধ থাকায় রেস্তোরাঁ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, চোখেমুখে হাসি নিয়ে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ব্যবসা বন্ধের মতো অবস্থা ছিল। আজ আবার মানুষ দেখছি, দোকান খুলেছি’। মনে হলো, দ্বীপটা আবার বেঁচে উঠল।

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা, প্রবাল রক্ষায় কাজ করা যুবক ওসমান গণি বলেন, ‘পর্যটন আমাদের জীবিকা, কিন্তু পরিবেশও বুঝতে হবে’। এবার যে নিয়মণ্ডকানুন কঠোর করা হয়েছে, এতে প্রবাল আর প্রকৃতি একটু হলেও বাঁচবে বলে আশা করি। ঢাকা মগবাজার থেকে আসা পর্যটক আরফাত হোসেন প্রথমবার সেন্টমার্টিনে পা রেখে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রযাত্রাটা দারুণ ছিল। দ্বীপে নামার পরই মনে হলো স্বর্গে চলে এসেছি। এতদিন অপেক্ষা করে এসে সত্যিই ভালো লাগছে’। আজহারুল ইসলাম নামের আরেক পর্যটক বলেন, ‘দ্বীপে প্রবেশের সময় কিউআর কোড স্ক্যান, তথ্য যাচাই, সবই খুব সুশৃঙ্খল লাগল। নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত। এবার একটু গোছানো মনে হয়েছে।

দ্বীপের পূর্বপাড়ার ব্লু সী রিসোর্ট-এর ম্যানেজার মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করে হোটেল রিসোর্ট মেরামত ও সংস্কার করেছে মালিকরা। দুই দিনে যা পর্যটক এসেছে তাতে মাত্র চারটি রুম বুকিং হলো আজ। প্রথম দিনে পর্যটকও আসেনি রিসোর্টে। তিনি বলেন, এই বছর সরকারি নিয়মনীতির কারণে দু’মাসে ব্যবসায়ীরা খরচ পুষিয়ে নিতে পারবে বলে মনে হয় না।

কোস্টাল প্যালেস রিসোর্টের ইয়াসিন জানান, দুই দিনে, মাত্র ৪০ শতাংশ রুম সেল হলো। সব রিসোর্টের দু’য়েকটি করে রুম সেল হয়েছে। অনেক রিসোর্ট এখনও খোলেনি, কেউ কেউ মাত্র রিসোর্টের সংস্কার কাজ ধরেছে। সী ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘আজ মঙ্গলবার তিনটি জাহাজে ১ হাজার ১৯৪ জন যাত্রী সেন্টমার্টিন গেছেন’।

ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘাটে, প্রতিটি জাহাজে এবং দ্বীপে পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট পুলিশ মোতায়েন আছে’। সার্বক্ষণিক সেবা এবং নজরদারি চলছে। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই সহযোগিতা করছি।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জমির উদ্দিন বলেন, ‘জাহাজগুলো কঠোর নজরদারিতে থাকবে এবং দৈনিক দুই হাজারের বেশি পর্যটক যেতে দেওয়া হবে না। নুনিয়ারছড়া ও সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে পৃথক তল্লাশির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, আরও চারটি জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি পেলেই ধাপে ধাপে সেগুলোও রুটে নামবে। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাস নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকেই পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল অব্যাহত থাকবে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গত ২২ অক্টোবর ১২টি নির্দেশনাসহ প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ ছিল। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস পর্যটকেরা ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন, তবে মেনে চলতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্দেশনাগুলো হলো, নভেম্বরে দিনভর ভ্রমণের সুযোগ থাকবে; রাতযাপন নিষিদ্ধ। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাতযাপন করা যাবে।

এছাড়া অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান সেন্টমার্টিনে যাতায়াত করতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টাল থেকে অনলাইনে টিকিট নিতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে; কিউআর কোড-বিহীন টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার টানা ৯ মাস সেন্টমার্টিনে পর্যটক প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ থাকবে। ভ্রমণ সময়সূচি ও পর্যটকসংখ্যা এবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয় এবং সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ যেকোনো জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যেকোনো মোটরচালিত যান চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে।

ভ্রমণকালে পলিথিন বহন করা যাবে না। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ বা ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজেদের পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।