ঈশ্বরদীতে একদিনে পেঁয়াজের দাম বাড়লো ৪০ টাকা

প্রকাশ : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ

  আলমাস আলী, ঈশ্বরদী (পাবনা)

পাবনার ঈশ্বরদীর হাট-বাজারে হঠাৎ লাগামহীন হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের দাম। ঈশ্বরদী বাজার ও গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ হাট-বাজারেই দেশি পুরাতন পেঁয়াজ মার্কেটে সরবরাহ নেই বললেই চলে। কোনো কোনো বাজারে কোনো দোকানে পাওয়া গেলেও বিক্রেতার দাম হাঁকেন ১৬০ টাকা।

খুচরা বিক্রেতারা জানান, বৃহস্পতিবারই আমরা দেশি পুরাতন পেঁয়াজ ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রয় করেছি। অথচ একদিনের ব্যবধানে আজ শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে দেখি পাইকারি মার্কেটে দেশি পুরাতন পেঁয়াজ নেই, কারো কাছে থাকলেও পাইকারিতেই ১৫০ টাকা দাম চাচ্ছেন। এই দামে কিনে কোনো কোনো খুচরা বিক্রেতা ১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন। অপরদিকে সদ্য বাজারে ওঠা মুড়িকাটা পেঁয়াজের পাইকারি দর ছিল প্রতি কেজি ৭০ টাকা। খুচরায় বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। আজ শুক্রবার সেই মুড়ি কাটা পেঁয়াজ পাইকারি প্রতি কেজি কিনতে হয়েছে মানভেদে ১০৫ টাকা থেকে ১১০ টাকায়। আমরা খুচরাতে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। খুচরা বাজারে এক দিনের ব্যবধানে পুরাতন দেশি ও মুড়িকাটা উভয় পেঁয়াজের দামই কেজিতে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে মুড়িকাটা ১২০ টাকা ও দেশি পুরাতন পেঁয়াজ ১৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

শুক্রবার শহর ও শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলের হাটবাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার মানভেদে প্রতিকেজি মুড়ি কাটা পেঁয়াজ খুচরা ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও একদিনের ব্যবধানে শুক্রবার বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

ঈশ্বরদীতে বিভিন্ন বাজারে পেঁয়াজের খুচরা ক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা গেছে। পেঁয়াজ কিনতে আসা খুচরা ক্রেতা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, গতকাল যে দেশি পেঁয়াজ কিনেছিলাম ১১৫ টাকা দিয়ে, আজকে কিনছি ১৬০ টাকা। পরিমাণে কম করে কিনেছি।

উপজেলার আরামবাড়িয়া বাজারের কাঁচামালের খুচরা ব্যবসায়ী বিপুল আলী বলেন, সরবরাহ সংকটের কারণেই পুরোনো পেঁয়াজের দাম এবং মুড়ি কাটা পেঁয়াজের দাম এমন চড়া হয়েছে। তাদের মতে, পাইকারি দাম বেশি থাকায় খুচরা বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

কাঁচা বাজারের আড়তদার এবং ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বন্ধ থাকায় দেশি পেঁয়াজের ওপর চাপ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমায় বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মূলত দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ সংকটের কারণে দাম বাড়ছে। অন্যদিকে আগাম কিছু মুড়ি কাটা পেঁয়াজ বাজারে আসলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

কৃষক, ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দেশে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ। স্থানীয় উৎপাদন থেকেই চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ হচ্ছে বাজারে। তবে এখন মৌসুমের শেষে মজুদ কমে আসায় বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। বছরজুড়ে স্থিতিশীল থাকলেও এক দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। বৃহস্পতিবার পাইকারি মুড়ি কাটা পেঁয়াজ ৭০ টাকা ও দেশি পুরাতন ১১০ টাকা কেজি পাইকারি বিক্রি হয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা মুড়িকাটা ৮০ টাকা কেজি ও দেশি পুরাতন পেঁয়াজ ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। অথচ একদিনের ব্যবধানে শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) পাইকারি পর্যায়ে দেশী পুরাতন পেঁয়াজ সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। কারো কাছে থাকলেও পাইকারিতেই দেশি পুরাতন পেঁয়াজ ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলাগুলোয় দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারে প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরদীর কাঁচামালের ব্যবসায়ীরা। তারা আরও বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদনের এলাকা পাবনাতেই গত এক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।

ঈশ্বরদী পৌর শহর বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা আবুল হাসেম বলেন, গত দশ মাস দেশী পেঁয়াজের সরবরাহ ভালো থাকায় দাম স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু বর্তমানে মোকামগুলোয় পেঁয়াজের সরবরাহ কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে মসলা পণ্যটির দামে।’

উপজেলার আরামবাড়িয়া বাজারের কাঁচামালের ব্যবসায়ী মিলন, খোকন ও আনসার আলী বলেন, ঈশ্বরদী বাজার ও গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ হাট-বাজারেই দেশি পুরাতন পেঁয়াজ মার্কেট থেকে উধাও। কোনো কোনো বাজারে কোনো দোকানে পাওয়া গেলেও বিক্রেতার দাম হাঁকছেন ১৬০ টাকা। চলতি ডিসেম্বরের শেষার্ধে কিংবা জানুয়ারির শুরুতে দেশে মুড়িকাটা পেঁয়াজের উত্তোলন মৌসুম শুরু হবে। এখন আগাম কিছু মুড়ি কাটা পেঁয়াজ বাজারে আসলেও তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে আগামী অন্তত এক মাস দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ধারাবাহিকভাবে কমবে। এ কারণে সামনের এক মাস পেঁয়াজের বাজার চড়া থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।

কৃষক, ব্যবসায়ী ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে রবি মৌসুম শুরু হয় অক্টোবরের মাঝামাঝি। এরই মধ্যে পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ীসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পেঁয়াজের রোপণ হয়েছে। বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে রোপণ কয়েকদিন দেরিতে শুরু হওয়ার পরে, আবার গত কয়েকদিন আগে পেঁয়াজ রোপণের এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে লাগানো পেঁয়াজ এক দফা নষ্ট হয়। ওইসব জমিতে কৃষকদের আবার নতুন করে পেঁয়াজ লাগানো হয়েছে। যা বাজারে আসতে আরো দেরি হবে। এতে হঠাৎ করেই সরবরাহ কমে যায়। মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ না আসা পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে পেঁয়াজ আমদানির আইপি (আমদানি অনুমোদন) দেওয়া না হলে সামনের দিনে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

ব্যবসায়ীরা আরো বলছেন, দীর্ঘদিন মাচায় মজুদ থাকায় শুকিয়ে পেঁয়াজের ওজন কমে যায়। এ কারণে বর্তমানে ব্যাপারী ও কৃষক পর্যায় থেকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের সময় মুনাফা বজায় রাখতে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এতেও বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।

দেশে দুই ধাপে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। রবি মৌসুমের শুরুতে পেঁয়াজের চারা (মুড়িকাটা) রোপণ করা হয়। এ জাতের পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। উৎপাদন মৌসুমেই এসব পেঁয়াজ বিক্রি ও ভোগ করে সাধারণ ভোক্তারা। মুড়িকাটা পেঁয়াজ উত্তোলন শেষ হলে একই জমিতে কৃষক হালি বা বীজ পেঁয়াজ রোপণ করেন। এ পেঁয়াজ মাচা বা বিভিন্ন সংরক্ষণ ঘরে দীর্ঘদিন মজুদ রাখা হয়। দীর্ঘদিন ধরে দেশে পেঁয়াজ আমদানিতে আইপি দিচ্ছে না সরকার। এতে বাজার দেশীয় উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে এবং একটি নির্দিষ্ট দামে পৌঁছে পেঁয়াজের দাম স্থির ছিল। কিন্তু এখন মৌসুম শেষ হয়ে আসায় দাম কিছুটা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল মমিন বলেন, এবার অতিবৃষ্টির কারণে কৃষকের আগাম মুড়ি কাটা পেঁয়াজ পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারে আসেনি। কাঁচামালের দাম একসময় কম আর একসময় বেশি হয়। কৃষকের মাঠে এবং তাদের কাছে পেঁয়াজের মজুদ কমে গিয়েছে। অনেক কৃষক আগের তুলনায় বাড়তি জমিতে পেঁয়াজ রোপণ করেছেন।

ফলে মৌসুমের শেষ দিকে দাম কিছুটা বাড়তি থাকলেও পেঁয়াজের দেশীয় উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।