৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর হানাদার মুক্ত দিবস
প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৪১ | অনলাইন সংস্করণ
চাঁদপুর প্রতিনিধি

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত হয়েছিল। এদিনে চাঁদপুর সদর মডেল থানার সামনে বিএলএফ বাহিনীর প্রধান মরহুম রবিউল আউয়াল কিরণ প্রথম চাঁদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তির সংগ্রামে জেলার মুক্তিকামী জনতা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল চাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী দুটি প্লেন থেকে সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রথম আক্রমণের সূচনা করে। প্রথম দিনেই হামলায় শহরের বাণিজ্যিক এলাকা পুরান বাজারের এক নারী পথচারী নিহত হন। পরের দিন বিকেলে প্রায় ৫ শতাধিক পাকসেনার একটি বহর চাঁদপুর প্রবেশ করে।
শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে চাঁদপুর সরকারি কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়টি অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসটি নির্ধারণ করা হয়েছিল। ওই স্কুলের মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতো লতুফা বেগম নামে এক বৃদ্ধা গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন।
এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা রাতের আহার জোগাড় করার জন্য প্রথম অপারেশন হিসেবে ওই বৃদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে এবং বৃদ্ধার একটি গরু ও একটি ছাগল নিয়ে যায়।
এপ্রিল থেকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দফায় দফায় গোলাগুলি চলতে থাকে। পরে গঠন করা হয় শান্তিবাহিনী। এরপর নতুন কায়দায় শান্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় বর্বর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ৩৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাক সেনারা পালিয়ে যায়।
৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের দোসররা কত লোককে হত্যা করেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। চাঁদপুর জেলায় (তৎকালীন মহকুমা) সর্বশেষ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ৭ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর। যৌথ বাহিনী হাজীগঞ্জ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর আসতে থাকলে মুক্তিসেনারা হানাদার বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।
ভারতীয় গার্ডস রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণ চালায়। দিশাহীন হয়ে পাকিস্তানি সেনারা ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে দুটি জাহাজে নৌ-পথে ঢাকার উদ্দেশে চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর ট্যাংক ও প্লেনের আক্রমণে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
চাঁদপুর মুক্ত দিবসের কর্মসূচি
চাঁদপুর মুক্ত দিবস উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসক এর পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে কর্মসূচি। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—সকাল ১০টায় শহরের মুক্তিযোদ্ধা সড়কে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ‘অঙ্গীকার’ পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদন। এছাড়া একই স্থানে বেলুন ও পোস্টার উড়িয়ে দেওয়া হবে। সবশেষে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করা হবে।
এই কর্মসূচিতে জেলা সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. এরশাদ উদ্দিন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও শহীদের কীর্তি
৮ এপ্রিল রাতেও চাঁদপুরে অবস্থানরত ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা চালায়। পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা গুলি ছুঁড়ে প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। এতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মক আহত হন। ৯ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি মিলিটারি শহরে ঢুকে চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ইসমাইল হোসেন (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। একই সঙ্গে শহরের হাসান আলী হাইস্কুল মোড়ে দুই যুবককে হত্যা করা হয়।
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী বড় স্টেশন মোলহেড এলাকায় একটি টর্চার সেল স্থাপন করে। এখানে চাঁদপুর রেলপথ, সড়কপথ এবং নৌপথে যাত্রীদের ধরে এনে অমানবিক নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ চালানো হতো। পরে মৃতদেহগুলো পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ফেলে দেওয়া হতো।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদপুর পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০১৩ সালে বড় স্টেশনে ‘রক্তধারা’ নামে বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয়। এছাড়া চাঁদপুর শহরে ‘মুক্তিসৌধ’, ‘অঙ্গীকার’ ও ‘শপথ চত্বর’ নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৯২ সাল থেকে প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর চাঁদপুর শহরের হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০২৩ সালে স্থান পরিবর্তন করে আউটার স্টেডিয়ামে মেলা হয়েছে। তবে ২০২৪ সাল থেকে মেলার আয়োজন বন্ধ রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ মাস্টার জানিয়েছেন, ৮ ডিসেম্বর সকালে শহীদুল্লাহ ভুঁইয়া ও হোসেন ব্যাপারী বহরিয়া বাজারে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানি জাহাজ মেঘনা নদী দিয়ে চাঁদপুরের দিকে আসছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি চালায়, এতে একটি কিশোর ও একটি গবাদি পশু নিহত হয়।
পাকবাহিনী তিন নদীর মোহনায় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবেই ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হয়।
