সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত: ৩ গজের মধ্যে মসজিদ-মন্দির
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৪১ | অনলাইন সংস্করণ
পটিয়া প্রতিনিধি

চট্টগ্রামের পটিয়ায় মাত্র ৩ গজের মধ্যেই মসজিদ এবং মন্দিরের সহঅবস্থানকে কেন্দ্র করে দু-সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মধুর সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে। আর এ অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বৃট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতার জন্মভূমি ও স্মৃতিধন্য পটিয়ার ধলঘাটের কৃষ্ণখালী দেওয়ান হাট জামে মসজিদ ও কৃষ্ণখালী মাতৃ মন্দির।
এ উপসনালয়গুলোতে প্রতিদিন নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়; বিশেষ করে মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও সনাতনীরা তাদের নিয়মিত পূজা-অর্চনা করে থাকে।
শত বছর ধরে পারস্পরিক এ সহঅবস্থান থাকলেও এক মুঠো সময়ের জন্যও এখানে ধর্মীয় কোনো উত্তেজনা বা পরস্পর বিরোধের ঘটনা ঘটেনি।
১৯৮৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ভারতের বাবরী মসজিদ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ সারা দেশের ন্যায় পটিয়ায়ও ভীতি ছড়ায়। কিন্তু এ গ্রামে তার কোনো প্রভাব পড়েনি, বলে স্থানীয় ব্যবসায়ী অরুন কুমার দে ও মানিক জানিয়েছেন। ফলে পটিয়ায় এ দুই সম্প্রদায়ের মসজিদ ও মন্দিরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, পটিয়ার ধলঘাটের কৃষ্ণখালী দেওয়ান হাটে মুসলমানদের ইবাদতের জন্য মসজিদটি ১৯৪৪ সালে স্থানীয় সমাজসেবী আবদুল গফুরের অনুদানে নির্মিত হয় এবং ১৯১৮ সালে দেওয়ান হাট কৃষ্ণখালী মাতৃ মন্দির নির্মিত হয়। মন্দিরের জায়গা দান করেন তৎকালীন জমিদার প্রসন্ন বাবু।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর হক জানান, মুসলমানরা প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজ ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে ইবাদত-বন্দেগী করে থাকে। অপরদিকে সনাতনীরা তাদের প্রতিদিনের পূজা-অর্চনার পাশাপাশি দূর্গাপুজা, মনসা পুজা সহ বিভিন্ন পুজা অনুষ্ঠান ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের মধ্য দিয়ে পালন করে। মন্দিরে শারদীয় দুর্গোৎসব এবং মুসলমানরা ১২ রবিউল আওয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী (সঃ) পালন করেন।
দুটি ধর্মের ভিন্ন ধারায় ইবাদত-বন্দেগী হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে কট্টর ধর্মালম্বীদের মধ্যে তুচ্ছ বিষয়ে সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকলেও বিগত ১০০ বছরে এখানে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক মধুর হওয়ায় পটিয়ার ধলঘাটে কৃষ্ণখালী দেওয়ান হাটের ৩ গজ দূরত্বে অবস্থিত এ দুটি মসজিদ ও মন্দির দেখার জন্য দেশের দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা প্রতিদিন ভিড় করেন।
মসজিদের ইমাম এইচএম আরিফ কাদেরী জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে কখনো ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সনাতনীদের সঙ্গে মুসলমানদের কোনো বিরোধ দেখা যায়নি।
মন্দিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণ সন্তোষ দাশ জানান, তিনি দীর্ঘদিন মন্দিরের পূজা-অর্চনার দায়িত্বে রয়েছেন। কখনো কেউ তাদের পূজা-অর্চনায় বাধা দেয়নি; বরং উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করে।
সম্প্রতি পটিয়া উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে মসজিদ ও মন্দিরের চলাচল পথ আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন করা হয়েছে।
ধলঘাট ইউপির সাবেক মেম্বার ও সমাজসেবক শফিউল আলম বাদশা বলেন, পটিয়া হাজার বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির ভূমি। শত বছরের এ ঐতিহ্যকে লালন করতে সকল ধর্মের মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি বিধানে কাজ করার আহ্বান জানান।
দক্ষিণ ভূর্ষি ইউপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, এই এলাকার সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভাতৃত্বের বন্ধন শত বছরের ঐতিহ্যেরই অংশ। তিন গজের মধ্যেই অবস্থিত এ মসজিদ-মন্দির সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির উজ্জল দৃষ্টান্ত।
মন্দির কমিটির উপদেষ্টা দিলীপ ঘোষ দিপু মেম্বার বলেন, সকল ধর্মের মানুষ মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্যই আরাধনা করে। একেক জনের ইবাদতের ভাষা একেক রকম হলেও পটিয়ায় সকল ধর্মপ্রাণ। যার ফলে ভাতৃত্বের শত বছরের বন্ধন ৩ গজের মধ্যে এ মসজিদ-মন্দিরে উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
