রংপুরে নীরবতা ও দারিদ্র্য পেরিয়ে তিন অদম্য নারীর জয়গাঁথা

প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১:২৬ | অনলাইন সংস্করণ

  রংপুর ব্যুরো

নীরবতা, দারিদ্র্য, নির্যাতন কিংবা বাল্যবিবাহ—কোনো বাধাই শেষ পর্যন্ত থামাতে পারেনি তাদের এগিয়ে চলা। রংপুর জেলার গংগাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার তিন নারী প্রতিমা রানী রায়, সাবিনা বেগম ও মরিয়ম বেগম নিজেদের সংগ্রাম, সাহস ও পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ সমাজে স্বাবলম্বিতা ও আত্মমর্যাদার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার দক্ষিণ চেংমারি হিন্দুপাড়ার ৩৬ বছর বয়সী প্রতিমা রানী রায় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী।

শৈশব থেকেই সমাজের অবহেলা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন তিনি। অকালবিয়ে, সংসারে অবহেলা ও নির্যাতনের পর একপর্যায়ে স্বামীর পরিত্যাগ—সব মিলিয়ে জীবন হয়ে ওঠে আরও কঠিন। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসে অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে দিন পার করতেন তিনি।

এই সংগ্রামী জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র (জিবিকে) বাস্তবায়িত প্রসপারিটি প্রকল্পের এক জরিপে প্রতিমার জীবনসংগ্রাম নজরে আসে। প্রকল্পের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে তিনি অগ্রযাত্রা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ফোরামের সক্রিয় সদস্য হন। প্রতিবন্ধী ভাতা, টিসিবি সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান প্রতিমা।

অন্যের বাড়িতে কাজের পাশাপাশি তিনি শুরু করেন ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন। জিবিকে থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা পেয়ে তিনি একটি ছাগল কিনে ১৬ হাজার টাকা আয় করেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পিপিইপিপি-ইইউ প্রকল্প থেকে আরও ২৫ হাজার টাকা অনুদান পান। বর্তমানে তাঁর খামারে রয়েছে ১৮টি ছাগল, যার বাজারমূল্য প্রায় ৭৫ হাজার টাকা।

অদম্য সাহসের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি গংগাচড়া উপজেলা পর্যায়ে ‘নির্যাতনের দুঃস্বপ্ন মুছে জীবনযুদ্ধে জয়ী নারী’ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী পুরস্কার অর্জন করেছেন।

একই উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের বড়াইবাড়ি গ্রামের সাবিনা বেগমের গল্পও কম অনুপ্রেরণার নয়। দিনমজুর কৃষক মো. এরশাদ হোসেনের স্ত্রী সাবিনার পাঁচ সদস্যের সংসারে একসময় তিনবেলা খাবার জোটানোই ছিল বড় দুশ্চিন্তা। মূলধন ও দিকনির্দেশনার অভাবে কিছু করতে না পারলেও ২০২১ সালে গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র বাস্তবায়িত পিপিইপিপি-ইইউ প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার পর তার জীবনে আসে পরিবর্তন। ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১০টি দেশি মুরগি পালন শুরু করেন তিনি। প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তায় ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন সোনালী মুরগির খামার।

পর্যায়ক্রমে ২০০, ২৫০, ৩০০ এবং সর্বশেষ ৬০০টি সোনালী মুরগি পালন করে লাভবান হন সাবিনা। বর্তমানে তাঁর খামারে রয়েছে প্রায় ১১০০টি মুরগি, যার বাজারমূল্য প্রায় এক লাখ টাকা। তিনি ইতোমধ্যে ৩ হাজার মুরগির শেড নির্মাণ করেছেন। অন্য নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরিতেও ভূমিকা রাখছেন তিনি।

এই সাফল্যের জন্য সাবিনা বেগম ‘অর্থনৈতিকভাবে সফল নারী’ ক্যাটাগরিতে গংগাচড়া উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী পুরস্কার–২০২৫ অর্জন করেন।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের পশ্চিম চানঘাট গ্রামের মরিয়ম বেগমের জীবনও ছিল সংগ্রামে ভরা। অল্প বয়সে বিয়ে, দিনমজুর স্বামীর অনিশ্চিত আয় আর তিন সন্তানের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছে তাকে। পরিবারকে এগিয়ে নিতে তিনি যুক্ত হন গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের পিপিইপিপি-ইইউ প্রকল্পে। প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের মাধ্যমে খুঁজে পান বিকল্প আয়ের পথ। ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুটি বকনা বাছুর কিনে মাত্র চার মাসে ১৭ হাজার টাকা লাভ করেন মরিয়ম।

পরবর্তীতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব খামার। বর্তমানে তাঁর খামারে রয়েছে ৪টি গরু, ৪টি ছাগল, ১৮টি হাঁস ও ২৩টি মুরগি। দুধ বিক্রি করে নিয়মিত আয় করছেন তিনি। এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ মরিয়ম বেগম কাউনিয়া উপজেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ অদম্য নারী পুরস্কার–২০২৫’ অর্জন করেছেন।

প্রতিমা, সাবিনা ও মরিয়ম—তিন নারীর জীবনগাথা প্রমাণ করে, সুযোগ, সাহস ও পরিশ্রম এক হলে নীরবতা, দারিদ্র্য কিংবা বঞ্চনা কোনো কিছুই এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।