পতিত জমিতে তুলা চাষে ঝুঁকছে নকলার কৃষক
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:২৪ | অনলাইন সংস্করণ
মো. মোশারফ হোসাইন, নকলা (শেরপুর)

শেরপুরের নকলা উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত অনুর্বর নিষ্ফলা জমিতে তুলা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিটি তুলা গাছে ব্যাপক ফলন হয়েছে। খরচের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লাভ পাবেন বলে আশা করছেন চাষীরা।
কয়েক বছর ধরে জলবায়ু সহনশীল কার্পাস তুলা চাষে কম খরচে বেশি লাভ পাওয়ায়, নকলার স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে তুলা চাষে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। তুলা চাষে ঝুঁকছেন উপজেলার অপেক্ষাকৃত অনুর্বর এলাকার কৃষকরা। তুলার কোনো তুলনা নেই, বর্তমানে এটি সোনার মতো দামি সম্পদে পরিণত হয়েছে। কৃষকদের কাছে তুলাতো নয় যেন সাদা সোনা।
নকলায় কার্পাস তুলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন উপজেলার বাছুর আলগা, হালগড়া, চক বড়ইগাছি, কাজাইকাটা, মহিষমারী ও গোয়ালের কান্দা এলাকার অনেক কৃষক। অনুর্বর জমিতে কম পুঁজিতে নামমাত্র শ্রমে ও সরকারি প্রণোদনা পাওয়ায় উপজেলায় তুলা চাষের পরিমাণ ও চাষির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের উৎপাদিত তুলা সরাসরি তুলা উন্নয়ন বোর্ড ন্যায্য দামে কিনে নেওয়ায় বিক্রির জন্য বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয় না। ফলে কৃষকরা অন্য ফসলের তুলনায় সাদা সোনা খ্যাত তুলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন এবং অধিক লাভবান হচ্ছেন।
নকলা সাব কটন ইউনিট অফিস সূত্রে জানা গেছে, নকলায় গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি জমিতে তুলা চাষ করা হয়েছে। এ বছর বাছুর আলগা, হালগড়া, চক বড়ইগাছি, কাজাইকাটা ও মহিষমারী এই ৫টি ব্লকের আওতায় ৮০ হেক্টরে জমিতে ১৪৬ জন কৃষক তুলা চাষ করেছেন। হোয়াইট গোল্ড-১ ও ডিএম-৪ জাতের তুলা বেশি চাষ করা হয়েছে। এছাড়া এ বছর প্রথমবারের মতো চক বড়ইগাছি ব্লকে বিটি জেকেসিএইচ-১৯৪৭ জাতের তুলা পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হয়েছে। সরকারি সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রদর্শনী ও কৃষকের নিজ অর্থায়নেও চাষ করা হয়েছে। তুলার ভালো ফলন ও ন্যায্য দাম পাওয়ায় আগামীতে চাষির সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা করছেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় কৃষকরা।
কটন ইউনিট অফিসার মো. তোফায়েল আলম জানান, নকলা উপজেলায় ২০১৫ সালে সরকারি সহযোগিতায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্নত জাতের তুলা চাষ শুরু হয়। ওই বছর কৃষকরা সিবি-১২ এবং হাইব্রিড প্রজাতির রুপালি-১ জাতের তুলার চাষ করছিলেন। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের আগ্রহ বাড়তে থাকে। এরপরে হোয়াইট গোল্ড-১, হোয়াইট গোল্ড-২, পালী-১, সিডিবি হাইব্রিড-১, ডিএম-৪ ও সিবি-১৪ জাতের তুলা কৃষকরা চাষ করেছিলেন। তবে এসব তুলার মধ্যে হোয়াইট গোল্ড-১ ও ডিএম-৪ জাতের তুলার উৎপাদন বেশি হওয়ায় এই জাতগুলো এ বছর বেশি চাষ করা হয়েছে। তাছাড়া এবছর নকলায় বিটি জেকেসিএইচ-১৯৪৭ জাতের তুলা পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবার চাষ করা হয়েছে।
তিনি জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে তুলা চাষীদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসায় অন্যান্য এলাকার কৃষকরাও চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
তিনি আরো জানান, উন্নত এসব জাতের তুলা প্রতি বিঘাতে বীজসহ উৎপাদন হয় গড়ে ১৫ মণ থেকে ১৭ মণ। গত বছর প্রতিমণ বীজ তুলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ হাজার টাকা। চলতি মৌসুমে এখনও দাম নির্ধারণ করা হয়নি। তবে উৎপাদন খরচ কিছু বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষীদের ন্যায্য দাবি প্রতি মণ তুলার দাম যেন কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা করা হয়।
তুলা চাষিরা জানান, কৃষকদের জীবন মানের দিকে লক্ষ্য রেখে সকল পণ্যের বাজার মূল্যের সাথে তাল মিলানোর চিন্তা করলে গত বছরের তুলনায় এ বছর কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তুলার দাম বাড়াবে।
তারা আরো জানান, জমি তৈরি ও তুলার বীজ রোপণ থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমিতে সবকিছু মিলিয়ে গড়ে ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলায় না পরলে প্রতি বিঘা তুলার আবাদ থেকে ৪৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ পাবেন বলে তারা আশা করছেন।
তুলা চাষি করিমুল ও জসিম উদ্দিন জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ালে অনুর্বর, নিষ্ফলা বা অনাবাদি অনেক জমিতে তুলা চাষ করে কৃষক পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব। নিষ্ফলা জমিতে তুলা চাষ করায় একদিকে যেমন জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকরা অন্যান্য আবাদের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন। তাদের পরিবারে আসছে সচ্ছলতা। তাই উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ধান, গম, ভূট্টা, আলুসহ অন্যান্য আবাদ ছেড়ে তুলা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক।
জামালপুরের তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. ইসরাইল হোসেন জানান, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো কৃষিনির্ভর। এ দেশের প্রায় ৬৫ ভাগ বা আরো বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এখনো বিভিন্ন শস্য ও অর্থকরী বা শিল্প ফসল আমদানি নির্ভরতা কমেনি। তুলা এমন একটি আমদানি নির্ভর শিল্প ফসল। তুলা একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্প ফসল, যা বিশ্বব্যাপী ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮০ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে, কিন্তু চাহিদার কম-বেশি ৫ শতাংশ দেশে উৎপাদন হচ্ছে। তুলা উৎপাদনে এদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। তাই তুলা উন্নয়ন বোর্ড তুলার উৎপাদন বাড়াতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি আরো জানান, জাত ভেদে তুলার বীজ বুনতে হয় ৭.৫ কেজি থেকে ১৮ কেজি। বীজ বপনের ৬ মাস পরে তুলা সংগ্রহ করা যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলা চাষ ছড়িয়ে দিতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও বিভিন্ন প্রকল্প কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে ৩টি শস্য মৌসুমের মধ্যে খরিপ-২ মৌসুমে কিছু জমিতে তুলা চাষ করা হয়। এই তুলা আবাদ থেকে তুলার আঁশ ছাড়াও ভোজ্যতেল, খইল ও জ্বালানি উপজাত হিসেবে লাকড়ি পাওয়া যায়।
পুষ্টি বিজ্ঞানের মতে, তুলার ভোজ্যতেলে খুব কম পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে তেল পাওয়া যায়; যা উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ এবং সয়াবিন তেলের চেয়েও পুষ্টিকর। আর তুলার খইলে ২৪ শতাংশ উচ্চ প্রোটিন পাওয়া যায়, ২০ শতাংশ হারে উচ্চ ফ্যাট ও ৪০ শতাংশ ক্রুড আঁশ পাওয়া যায়; যা পশু ও মৎস্য স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তুলা-এ দেশে উৎপাদন করতে পারলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব বলে অনেকে মনে করছেন।
ময়মনসিংহ জোনের প্রধান তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. খালেদা ইয়াসমিন-এর নির্দেশ মোতাবেক জামালপুরের তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেনসহ কটন ইউনিট কর্মকর্তা ও সাব ইউনিট কর্মকর্তাগণ তুলার মাঠ পরিদর্শনসহ কৃষকদের নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরামর্শ সেবা দিচ্ছেন।
দেশব্যাপী তুলা চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালকসহ আঞ্চলিক কর্মকর্তা, সম্প্রসারিত তুলা চাষ প্রকল্পের কর্মকর্তাগণ, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের বিজ্ঞানী ও তুলা উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ, ইউনিট কর্মকর্তা ও সাব ইউনিট কর্মকর্তারা দেশব্যাপী আবাদ করা বিভিন্ন তুলার মাঠ পরিদর্শন করে চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ সেবা প্রদান করার পাশাপাশি উদ্বুদ্ধকরণ আলোচনা সভা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে তুলা চাষের প্রতি কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকে। নিয়ম মেনে চাষ ও সুষ্ঠুভাবে তুলা সংগ্রহ করতে পারলে সহজেই স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তাতে একদিকে বাড়বে কৃষি আয়, অন্যদিকে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান। ফলে কিছুটা হলেও বেকারত্ব কমবে বলে মনে করছেন কৃষি গবেষকগণ।
