ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রমজানে অস্থির হয়ে উঠতে পারে ভোগ্যপণ্যের বাজার

রমজানে অস্থির হয়ে উঠতে পারে ভোগ্যপণ্যের বাজার

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকটি উদ্যোগের পরেও ডলার সংকট ও এলসি খোলা নিয়ে জটিলতা কাটেনি। ফলে চাহিদার বিপরীতে ক্রমেই কমছে আমদানি। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা। আমদানিকারকদের ভাষ্য, চাহিদা অনুপাতে পণ্যের যোগান ও সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হতে পারে আসন্ন রমজান মাসে। এতে অস্থির হয়ে উঠতে পারে ভোগ্যপণ্যের বাজার। যার ফল ভোগ করতে হবে ভোক্তা সাধারণকে। বিপর্যয় নেমে আসতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্যেও।

ব্যবসায়ীরা জানান, আগামী মার্চে রমজান মাস শুরু হচ্ছে। রমজানের বাজার ধরার জন্য ব্যবসায়ীরা দুই-আড়াই মাস আগে থেকে পণ্য গুদামজাতকরণ শুরু করেন। পরবর্তীতে সেসব পণ্য ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করেন তারা। কিন্তু এবার চিত্রটা ভিন্ন। ডলার সংকটের অজুহাত দেখিয়ে অনেক ব্যাংকই আগের মতো এলসি (ঋণপত্র) খুলছেন না। যার ফলে রমজানের পণ্য আমদানিতে কিছুটা বিঘ্ন ঘটছে। ব্যবসায়ীদের হাতে আর দুই মাসের মতো সময় আছে। চলমান সংকট যদি এখনই সমাধান না হয় তাহলে আসন্ন রমজানে ভোগাবে ভোক্তাদের।

ব্যবসায়ীরা আরও জানান, বাংলাদেশে গত মে মাস থেকেই ডলারের সংকট তীব্র হতে শুরু করে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। এ কারণে ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে অনেক জরুরি পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়ছে। তবে দুই-তিন মাস আগে আমদানির কারণে বাজারে এখনও পণ্যের ঘাটতি তৈরি হয়নি। কিন্তু পরিবহন খরচ ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখনও বাজারে পণ্যের দাম বেশি। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে ছোলা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭৮ টাকায়। এ ছাড়া সাদা মটর ৫৯ টাকা, মটর ডাল ৬০, মসুর ডাল (চিকন) ১৩০, (মোটা) ৯০ এবং ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ ১ হাজার ৬৫০ টাকায়।

অন্যদিকে সয়াবিন তেল প্রতিমণ বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৬৮০ টাকা এবং পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৬০০ টাকায়। চিনি প্রতিমণ ৩ হাজার ৯৫০ টাকা, ভারতীয় মরিচ কেজি ৪৬৯, হলুদ ১১০, রসুন ৯৫, আদা ১২০ এবং পেঁয়াজ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়। অন্যদিকে এলাচ ১ হাজার ২০০, লবঙ্গ ১ হাজার ৮০ এবং দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৪৭০ টাকায়।

আড়তদাররা জানান, রমজান এলে শরবতের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই চিনির ব্যবহারও বাড়ে কয়েকগুণ। বর্তমান বাজারে চিনির দাম চড়া হলেও সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। এ ছাড়া সারা দেশে প্রায় ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদা থাকে। তবে এখন পর্যন্ত ছোলার সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। অন্যদিকে রমজানে খেজুরের আলাদা চাহিদা থাকে। সাধারণত খেজুর আমদানি হয় ইরান, তিউনিসিয়া, দুবাই ও সৌদি আরব থেকে।

খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক ও বিএসএম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী আবুল বশর চৌধুরী বলেন, বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম এখনও চড়া। এর মধ্যে অনেক ব্যাংক এলসি খুলছে না। যার ফলে আমদানি আগের চেয়ে কমেছে। আমদানি কমার কারণে দামে প্রভাব পড়বে, সেটাই বলাবাহুল্য।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডলার সংকটের কথা বলে মাঝারি ও ছোট আমদানিকারকদের এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে ব্যাংক। এমনকি ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশনা থাকলেও ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি নিচ্ছে না। অথচ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির কারণে অর্থবছরের প্রথম দুই-তিন মাস (জুন-আগস্ট) কম প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কিছুটা কমলেও পরে তা আবার বেড়ে যায়। বিলাসপণ্যের আমদানি বৃদ্ধি ডলার সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য মতে, আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৯টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২টিতে। এমনকি ডলার সংকট বাড়ার পরও গত অক্টোবরে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ১৩টি। স্ক্র্যাপ জাহাজের মতো ফল আমদানিও জুলাইয়ের পর থেকে বেড়েছে। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২১ হাজার ৫৭১ মেট্রিক টন কমলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর ও নাশপতি আসে। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৫৪ মেট্রিক টনে। আর সেপ্টেম্বরে আমদানি হয় ৩৪ হাজার ১৯০ টন। আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৮ হাজার টন বেড়ে সর্বশেষ অক্টোবর মাসে আমদানি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৮৮ টন।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশ কয়েকটি নির্দেশনার পরও খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকদের এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। সময়ক্ষেপণ করে ব্যবসায়ীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে ব্যাংক। ডলার সংকটের কথা বলা হলেও কেউ কেউ ম্যানেজ করে কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে। অথচ বাংলাদেশ মুক্ত অর্থনীতির দেশ। এখানে ছোট-বড় সবার সমান সুযোগ থাকা দরকার। তা না হলে ব্যবসায়ীদের বৃহৎ একটি অংশ দেউলিয়া হয়ে যাবে।

একই কথা বলেছেন চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ব্যাংক ডলারের সংকটের কথা বলছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের এলসি নেওয়া হচ্ছে না। তবে এই ফাঁকে কেউ কেউ কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে। আমি এই বিষয়টি উচ্চপর্যায়ে অবহিত করেছি। এদিকে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ রমজানে বেশি প্রয়োজনীয় আটটি পণ্যের আমদানিতে এলসি মার্জিন বা নগদ জমা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা এবং এসব পণ্য ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এরপর এলসি মার্জিনে ছাড় দেওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে চাল ও গম। তবে ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহকারী বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ ধরনের সুযোগ আগে থেকেই পেয়ে আসছে। ফলে এ নির্দেশনায় আমদানির ক্ষেত্রে সংকট কাটবে না। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই রোজার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সংস্থানের দাবি জানিয়েছে। তারা ডলার সংস্থানেই এর সমাধান দেখছেন। পণ্য আমদানির জন্য ডলারের সরবরাহ বাড়ানোই জরুরি মনে করছেন।

এ ছাড়া আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে চাহিদা মেটাতে সাতটি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল গঠন করার কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আমদানি-রফতানিসহ দেশের সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে একটি সভায় বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, চলতি ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ছোলা, মসুর ডাল, খেজুর, অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল, চিনি ও গম আমদানিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। আগামী মার্চে শুরু হতে যাওয়া রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখতে এ পরিমাণ পণ্য আমদানি প্রয়োজন বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এর মধ্যে ৮১২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ২২.১৯ লাখ টন গম, ৯৭৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৭ লাখ টন ভোজ্য তেল এবং ৮ লাখ টন চিনি আমদানিতে ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। এ ছাড়া ছোলা আমদানিতে ১৩৪.৪৯ মিলিয়ন ডলার, খেজুর আমদানিতে ৫২.৬৭ মিলিয়ন ডলার এবং মসুর ডাল আমদানিতে ১৪০.৬৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।

রমজান,অর্থনীতি
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত