অহংকারী আদ জাতির ধ্বংস হয়েছিল যেভাবে
প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:০০ | অনলাইন সংস্করণ
মাওলানা সাইফুল ইসলাম সালেহী

আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে। যারা নিজেদের খুব শক্তিশালী মনে করে। তাদের অত্যাচারে প্রতিবেশী অসহায়। অনেকে শক্তির প্রভাব খাটিয়ে অন্যজনের জায়গা জমিন ও বাড়িঘর দখল করে থাকেন। হযরত নুহ (আ.) এর বংশধরদের মধ্যে আদ নামক এক ক্ষমতাশালী বাদশাহ ছিলেন। তার সমকক্ষ শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি সে যুগে অন্য আর কেউই ছিল না। এ বাদশাহ সন্তানসন্ততি ও বংশধরগণও সবদিক দিয়ে শক্তিমান ও প্রভাবশালী ছিল। বাদশাহ আদের নামানুসারে এরা কওমে আদ বা আদ বংশীয় লোক নামে ইতিহাসে পরিচিত। এদের মধ্যে কোনো কোনো লোকের দেহের উচ্চতা ছিল চারশত গজ পর্যন্ত। এদের মধ্যম শ্রেণির লোকদের উচ্চতা ছিল দুইশত গজ। আর যারা সবচেয়ে খাটো তাদের উচ্চতা ছিল সত্তর গজ। ওরা সবাই যেমন ছিল সাহসী, তেমনি ছিল শক্তিশালী। তারা ছিল খুব অহংকারী ও তাদের অন্তর ছিল খুব কঠিন। তারা সত্যকে মিথ্যা বলত, মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করত। তারা দুর্বল ও নিরীহ মানুষকে খুব অত্যাচার করত। তাদের বাসভূমি ছিল ইয়ামান দেশের আহ্কাফ নামক জায়গা। তারা ছিল মরুচারী ও পাহাড়ি লোক। (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
সাহস ও শক্তির গৌরবে তারা আল্লাহ ও নবীকে ভুলে গিয়েছিলেন। তারা সৎকাজ ও ভালো কাজ কখনও করত না, বরং শয়তানের কুপরামর্শে দেবদেবীর মূর্তির পূজা করত। আদ কওমের যখন এ অবস্থা প্রবল আকার ধারণ করল, তখন তাদের হেদায়াত করার উদ্দেশ্যে আল্লাহপাক কওমে আদের মধ্য হতেই হুদ নামক এক ব্যক্তিকে নবীরূপে প্রেরণ করলেন। আল্লাহ বললেন, আদ জাতির নিকট তাদের ভাই হুদকে নবীরূপে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই, তোমরা কি সাবধান হবে না? (সুরা আল আরাফ : ৬৫)। হজরত হুদ (আ.) আদ জাতিকে দেব দেবীর মূর্তি পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে বললেন। তখন তারা নবীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করল। পবিত্র কোরআনে এসেছে, তার জাতির নেতারা বলল, ‘আমরা তোমাকে নির্বোধ দেখছি এবং আমরা তো তোমাকে নিশ্চিতরূপে মিথ্যাবাদী মনে করি। সে (নবী) বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আমি নির্বোধ নই, বরং আমি হলাম সারা জাহানের রবের মনোনীত রাসুল। (সুরা আল আরাফ : ৬৬-৬৭)। শক্তিশালী আদ জাতিকে হজরত হুদ (আ.) আল্লাহর সত্য ধর্মের প্রতি আহ্বান করলেন এবং আল্লাহর নেয়ামত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য বললেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আমি আমার রবের বার্তা তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি, আর আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্ক্ষী। তোমরা কি এতে বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদের জাতিরই এক লোকের মাধ্যমে তোমাদের রবের পক্ষ হতে তার বিধান ও উপদেশসহ তোমাদের কাছে এসেছে? তোমরা সেই অবস্থার কথা স্মরণ কর, যখন নুহের (আ.) সম্প্রদায়ের পর আল্লাহ তোমাদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অন্যদের অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে। (সুরা আল আরাফ : ৬৮-৬৯)।
হজরত হুদ (আ.) তাদের অনেক বুঝালেন। অনেক উপদেশ দিলেন। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেল না। হুদ (আ.) দীর্ঘদিন ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে তিনি সফল হননি। মাত্র সত্তরজন লোককে তিনি কোনোরূপে হেদায়াত করতে সক্ষম হলেন। তারাও কাফেরদের ভয়ে গোপনে আল্লাহর ইবাদত করত, প্রকাশ্যে ইবাদত করতে সাহস পেত না। তারপরেও হুদ (আ.) আদ জাতিকে ধর্মের পথে আহ্বান করতেছিলেন। আর আদ জাতি এভাবে তার উত্তর দিচ্ছিল, হুদ! তুমি কি আমাদের কাছে এ আশা করছ যে, আমরা তোমার কথামতো বাপ-দাদার ধর্ম দেবদেবীর পূজা ত্যাগ করে এক খোদার উপাসনা করব? তা তুমি জেনে রাখ, আমরা তোমার খোদার এবাদত করব না। তুমি যে তোমার খোদার ভয় দেখাচ্ছ যদি সত্যি হয়, তবে তা আমাদের প্রত্যক্ষ করাও না কেন? না হলে আমরা তো তা বিশ্বাস করবোই না; বরং আমরা তোমাকে জানে মেরে ফেলব। কোরআন মাজিদে এসেছে, ‘তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট শুধু এই উদ্দেশ্যে এসেছ যে, আমরা যেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের পূজা করত তাদের বর্জন করি? তুমি তোমার কথা ও দাবিতে সত্যবাদী হলে আমাদের যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর। (সুরা আল আরাফ : ৭১)।
হুদ (আ.) এদের সম্পর্কে একেবারে নিরাশ হয়ে আল্লাহর দরবারে এরূপ দোয়া করলেন, হে মাবুদ! এরা আমার কথা শুনছে না, বরং আমাকে প্রাণে মারার ভয় দেখাচ্ছে। আমার এমন শক্তিও নেই যে, আমি তাদের সঙ্গে পেরে উঠব। তারা অনেক শক্তিশালী। আপনি আমাকে তাদের হাত হতে রক্ষা করুন। বাদশাহ এমন বেশি শক্তির অধিকারী ছিল যে, সে যখন কোনো পাথরের উপর দিয়ে হেঁটে যেত তার জানু পর্যন্ত ওই পাথরের মধ্যে ডুবে যেত। শক্তির গর্বে আদ কওমের লোকেরা এরূপ বলত যে, কে আছে সারা জাহানের বুকে আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? হুদ (আ.) তার সত্তরজন মুমিন উম্মত নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাওয়ার সময় আরও একবার কাফেরদের সত্যধর্মের প্রতি আহ্বান করে বললেন, এখনও তোমরা আমার কথা মেনে নাও। না হলে কিন্তু অচিরেই তোমরা আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আদ জাতি হজরত হুদ (আ.)-এর কথা শুনে তাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করল। যার ফলে আল্লাহতায়ালা তাদের দেশে একাধারে তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ রাখলেন। দেশে কোনো ফসলাদি জন্মাল না। ফলে সারা দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। গজব শুরু হওয়ার আগে হজরত হুদ (আ.) তার উম্মতকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করলেন। আল্লাহ বলেন, অতঃপর তাকে (হুদকে) এবং তার সঙ্গী সাথীদের আমার অনুগ্রহে রক্ষা করলাম, আর যারা আমার নিদর্শনসমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল এবং যারা ঈমানদার ছিল না তাদের মূলোৎপাটন করলাম। (সুরা আল আরাফ : ৭২)। কিছুক্ষণ পর ভয়াবহ গজব শুরু হলো। মূহূর্তের মধ্যে এমন প্রবল বেগে তুফান শুরু হলো যে, দাম্ভিক আদ কওমের লোকদের সব দাঁত মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তাদের ঘরবাড়ি প্রথম ঝাপটায়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। দ্বিতীয়বারে তাদের আশ্রয়স্থল পাহাড়ের গুহাসমূহে বায়ু প্রবেশ করে তাদের সবাইকে বাইরে উড়িয়ে এনে এমনভাবে আছাড় মারল যে, সাত লক্ষ মানুষের দেহগুলো যেন উৎপাটিত খেজুর গাছের মতো নিষ্প্রাণ দেহে ভূমিতলে পড়ে রইল। তারপর প্রবল বায়ুর তাণ্ডব ধুলা মাটি উড়িয়ে উক্ত লাশগুলোর উপরে এমনভাবে নিয়ে এলো যে, তাতে তারা চাপা পড়ে রইল। আল্লাহ বলেন, ‘আর আদ সম্প্রদায় তাদের ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা।’ (সুরা আল হাক্কাহ: ৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখনি তোমার রব কী করেছেন আদ বংশের?’ (সুরা আল ফাজর : ৬)।
লেখক : আলেম, গবেষক