ঢাকা শনিবার, ২৪ মে ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মানবসভ্যতায় কোরবানির ঐতিহ্য: ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি

মানবসভ্যতায় কোরবানির ঐতিহ্য: ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি

ইবরাহিম (আ.)-মানব ইবরাহিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নবীদের অন্যতম তিনি। তাঁর প্রবর্তিত হজ ও কোরবানির বিধান আমরা মুসলমানরা এখনও অনুসরণ করি। আসমানি ধর্ম হওয়ার দাবিদার ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও দাবি করে তারা আব্রাহামের অনুসারী। কিন্তু কোরআনের ভাষ্য ও বাস্তবতা প্রমাণ করে মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারী উম্মত মুসলিমরাই ইবরাহিম (আ.)-কে প্রকৃতপক্ষে অনুসরণ করে।

তৎকালীন ইরাকের বাবেল শহরে তখনকার একমাত্র পরাশক্তি নমরুদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। এর মধ্যে ইবরাহিম (আ.) বেড়ে উঠেন। যৌবনে তিনি নমরুদকে এক আল্লাহই বিশ্বাসের দাওয়াত দেন। বেশ কয়েকটি বিতর্কে নমরুদ ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে পরাজয়বরণ করে। মূর্তিপূজা ভয়ংকর ভণ্ডামি- এ কথা প্রমাণের জন্য একদিন সুযোগ বুঝে মন্দিরের বড় মূর্তিটি ছাড়া সবগুলো ভেঙে চুরমার করে দেন। এই অপরাধে ইবরাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। ইবরাহিম (আ.) জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসেন। এরপরও নমরুদের প্রচারযন্ত্রের প্রভাবে জনগণ ইবরাহিম (আ.)-এর ধর্মগ্রহণ করেনি। আল্লাহর আদেশে ইরাক ছেড়ে যান ইবরাহিম (আ.)। মিশরে পৌঁছে স্ত্রী সারাকে নিয়ে মিশর রাজার লোলুপ দৃষ্টিতে মহাবিপদের সম্মুখীন হন। অলৌকিকভাবে সেই বিপদ কেটে যায়। মিশরের রাজা সারাকে উপহার দেন একটি দাসী। নাম হাজেরা।

বৃদ্ধ বয়সেও সন্তানের মুখ না দেখার কারণে বিবি সারার প্রস্তাবে ইবরাহিম (আ.) হাজেরাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। হাজেরার কোলজুড়ে ফুটফুটে ইসমাইলের জন্ম হয়। একপর্যায়ে সারা বলেন, হাজেরা ও তার ছেলেকে আমি সহ্য করব না। আমার চোখের আড়ালে কোথাও দূরে নিয়ে রাখেন। নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার চেয়ে এই পরীক্ষা কোনো অংশে কম নয়। আল্লাহতায়ালার নির্দেশে তিনি কোলের একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী হাজেরাকে বনবাস দেন তরুলতাহীন জনমানবশূন্য পাথরের পাহাড়ঘেরা মরু-বিয়াবান মক্কায়। একমাত্র আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে তিনি কেনানে বা বর্তমান ফিলিস্তিনে চলে আসেন।

কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে বিবি হাজেরা ও শিশু ইসমাইলের জীবন। একটার চেয়ে একটা কঠিন পরীক্ষা। পানির অভাবে মৃতপ্রায় শিশু ইসমাইলের জন্য হাজেরা যখন অদূরে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াচ্ছিলেন, তখনই ইসমাইলের পায়ের তলা ফুটে বেরিয়ে আসে প্রসবন-জমজম। জমজম কূপকে কেন্দ্র করে মক্কায় গড়ে উঠে জনবসতি।

ইবরাহিম (আ.) ফিলিস্তিন থেকে স্ত্রী ও ছেলের খোঁজ নিতেন। বর্ণিত আছে, তিনি সকালে মক্কায় পৌঁছতেন দুপুরে বিশ্রাম নিতেন আবার সন্ধ্যায় ফিরে যেতেন। কীভাবে সম্ভব হতো এত দূরের পথ পাড়ি দেয়া। বলা হয়েছে, তিনি বেহেশতি বাহনে সওয়ার হয়ে আসতেন। আমি (লেখক) যখন ইরানে সাইরাস দ্য গ্রেটের সিংহাসনের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শন করি শিরাজের পার্সপোলিস-এ। তখন প্রাচীনকালের স্মৃতিবাহী দেয়ালগাত্রে উৎকীর্ণ দেখেছি ডানাযুক্ত ঘোড়া। তাতে বুঝা যায়, আগেরকার দিনে ডানাযুক্ত ঘোড়া ছিল- যা কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে। এসব ঘোড়ার বাহনে খুব দ্রুতই পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ভ্রমণ করা সম্ভব বলে অনুমান করা যায়।

ইসমাইল বেড়ে উঠলেন। অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজে চলার উপযুক্ত হলেন। এমনকি বাবাকে সাহায্য করার পর্যায়ে পৌঁছলেন। মুফাসসির ও সিরাত লেখকদের মতে, বয়স তখন তেরো বছর বা যৌবনপ্রাপ্ত, তখন ইবরাহিম (আ.) আরও এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তিনি ৮ জিলহজ রাতে স্বপ্নে দেখেন একমাত্র প্রাণপ্রিয় ছেলে ইসমাইলকে জবাই করছেন। তাফসিরে খাজেনে এ ঘটনার বর্ণনা এভাবে রয়েছে- ইবরাহিম (আ.) তারবিয়ার রাতে (৮ জিলহজ) স্বপ্নে দেখেন, কেউ একজন তাকে বলছেন আল্লাহ তোমাকে আদেশ করেছেন, তোমার এই সন্তানকে জবাই করতে হবে। ভোর হওয়ার পর তার মনে সংশয় জাগল। অতঃপর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তিনি ভাবতে থাকলেন যে, এই স্বপ্নটি কি আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল, নাকি শয়তানের পক্ষ থেকে? এ কারণে দিনটি ইয়াউমুত তারবিয়া নামে আখ্যায়িত হয়।

বর্তমানে এই দিন ভোরেই হাজিরা মক্কা থেকে ইহরাম পড়ে মিনায় রওনা হন। সেখানে পুরো দিন ও সামনের রাত অবস্থান করে আরাফাহ ময়দানের উদ্দেশে রওনা হন। পরের রাতে তিনি দ্বিতীয়বার একই স্বপ্ন দেখেন। ভোরবেলা তিনি বুঝতে পারেন, এই স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে। অতএব, এই দিনটি ইয়াউমুল আরাফা বা জ্ঞাত বা পরিচিত হওয়ার দিন নামে আখ্যায়িত হয়। ইবরাহিম (আ.) এ স্বপ্নটি তিন রাত পরপর দেখেন। অতঃপর যেদিন তিনি কোরবানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সেদিনকে ইয়াউমুন নাহার বা কোরবানির দিন বলা হয়।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল, বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কী বলো। সে বলল, হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা বাস্তবায়ন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : ১০২)।

নবী-রাসুলদের স্বপ্নও সত্য এবং তা অহি বা প্রত্যাদেশ। তাই এই স্বপ্নের অর্থ ছিল, আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ইবরাহিম (আ.)-কে তার একমাত্র ছেলেকে কোরবানির আদেশ করা হয়েছে। এ আদেশটি স্বপ্নে দেখানোর পেছনে প্রজ্ঞা হলো, ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্য পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পাওয়া। কারণ, স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত আদেশকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে তিনি ছেলে কোরবানির মতো কঠিন কাজ থেকে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন। তা না করে তিনি আল্লাহর আদেশ শিরোধার্য করে নেন।’ (তাফসিরে কাবির)।

ইসমাইল (আ.)-কে জবাই করানো আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্য ছিল না। অথবা ইবরাহিম (আ.)-কেও এ আদেশ দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল না যে, প্রাণপ্রিয় ছেলেকে জবাই করে ফেলো বা হত্যা করো; বরং ছেলে ইসমাইলকে জবাই করার সর্বাত্মক প্রস্তুতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করে আল্লাহর মহব্বতের পরীক্ষা নেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। হুকুমটি স্বপ্নযোগে না হয়ে সরাসরি হলে এমন সুযোগ থাকত না। কাজেই ইবরাহিম (আ.)-কে স্বপ্নে দেখানো হলো, তিনি ইসমাইলকে জবাই করছেন, জবাই করে ফেলেছেন এমন নয়। জীবনভর প্রার্থনা করে পাওয়া একমাত্র সন্তান- যে আল্লাহর ইবাদত পালনে অগ্রসর, সুস্থ-সবল, ১৩ বছরের বা যৌবনপ্রাপ্ত এমন একটি ছেলেকে আল্লাহর মহব্বতে জবাই করা কত কঠিন পরীক্ষা, তা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।

ইবরাহিম (আ.) ছেলে ইসমাইলের পরামর্শ ও মতামত চাইলেন। নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সন্দেহের কারণে তিনি এই পরামর্শ চাননি; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার জন্য তাকে মনের দিক থেকে প্রস্তুত করা, তার ধৈর্যের মাত্রা যাচাই করা, আল্লাহর বিধান মাথা পেতে নেওয়ার জন্য তাকে অবিচল রাখার অভিপ্রায়ে তিনি ইসমাইলের মতামত জানতে চান। ইসমাইল জবাবে বললেন ‘হে আমার পিতা, আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তা বাস্তবায়ন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ ইনশাআল্লাহ মানে আল্লাহ যদি চান। ইসমাইল (আ.) বরকত হাসিলের জন্য এ কথাটি বলেছিলেন, অন্যথায় আল্লাহর রাস্তায় নিজের প্রাণ সঁপে দিতে তিনি আল্লাহর ইচ্ছাকে বাহানা হিসেবে পেশ করেননি। দ্বিতীয়ত আল্লাহর নামে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতো এত বড় কাজে নিজের কৃতিত্বের পরিবর্তে বিনয়ই প্রকাশ করেছেন। তিনি বলতে পারতেন যে, এ কাজে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন, তা না বলে তিনি বলেছেন, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। এভাবে তিনি উপরোক্ত বাক্যে অহংকার, আত্মপ্রীতি ও অহমিকার নামগন্ধটুকু শেষ করে দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিনয় ও সমর্পিত অবস্থা প্রকাশ করেছেন। (তাফসিরে রুহুল মাআনি)। এর দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, মানুষ কোনো ব্যাপারে নিজের ওপর যত আত্মবিশ্বাসই পোষণ করুক না কেন, গর্ব ও অহংকার প্রকাশ পেতে পারে এমন দাবি করা উচিত নয়। এমনভাবে বলতে হবে, যেন নিজের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর ভরসা প্রকাশ পায়। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন)।

মানবসভ্যতা,কোরবানি,ইসমাইল (আ.)
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত