জীবিকা নির্বাহ ও ইসলাম

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৪ | অনলাইন সংস্করণ

  আবদুল্লাহ নোমান

জগতের সবাই জীবিকা খোঁজে। খোঁজে শিকার ও খাদ্য-পানীয়। তবে উপায়-উপকরণ ও কলাকৌশল ভিন্ন ভিন্ন। যার পন্থা যত উন্নত ও বিস্তৃত, পদ্ধতি নিখুঁত ও যথাযথ, তার অর্জন ও উপার্জন তত বিশাল ও সমৃদ্ধ। কেউ রিজিক পায় অফিসকক্ষে- আরামে নরম চেয়ারে বসে কলম ঘুরায়, মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা পায়; কেউ রিজিক পায় এসি রুমে- তন্ময় হয়ে কম্পিউটারের বাটন চাপে, এতে তার রিজিক মেলে; কারও রিজিক থাকে রুটিছেঁকা উনুনের তাপে কিংবা রান্নাঘরের আগুনের উত্তাপে; কেউ রিজিক পায় পৌষ-মাঘের কনকনে শীতে ফুটপাতে শীতবস্ত্র বিক্রি করে; আবার কেউ পায় গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে ঠান্ডা পানীয় ও আইসক্রিম বিক্রি করে; কেউ জীবিকা খোঁজে রাস্তার পাশে ঝালমুড়ি বা বাদাম বিক্রি করে; আবার কেউ খোঁজে কঠোর পরিশ্রম করে রিক্সা বা ভ্যান চালিয়ে; একজনের রিজিক থাকে কচিকাঁচা কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে, নুরানি মক্তব ও প্রতিষ্ঠানের ফুলেল আঙিনায়; আরেকজনের রিজিক প্রাপ্তবয়স্ক কলিগদের সঙ্গে গার্মেন্টস ও কলকারখানায়; কারও রিজিক থাকে নদীর জলরাশিতে, সাগরের তলদেশে। সে মাসের পর মাস জাহাজে অবস্থান করে মাছ ধরে, তা বিক্রি করে প্রয়োজন পূরণ করে; কারও রিজিক থাকে আকাশের শূন্যতায়। সে পাইলট হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিমান চালায় আর রিজিক পায়। মূলত প্রজ্ঞাময় আল্লাহ প্রত্যেকের মনে সেই কাজের প্রেরণা সৃষ্টি করে দেন, যা তার জন্য অধিক উপযুক্ত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি তার অপার প্রজ্ঞায় বিশ্বের জীবনব্যবস্থা এমন সুচারুরূপে সাজিয়েছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি সে যতই ধনকুবের হোক না কেন, নিজ প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। সব মানুষকে এ পারস্পরিক মুখাপেক্ষিতার সূত্রে গেঁথে তিনি একদিকে যেমন সবার প্রয়োজন মেটাচ্ছেন, তেমনি বিস্ময়করভাবে সবার জীবিকার ব্যবস্থাও করছেন। পবিত্র কোরআনের চমৎকার বাণী- ‘তবে কি তারাই আপনার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করবে? পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকাও তো আমিই বণ্টন করেছি এবং আমিই তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর মর্যাদায় উন্নত করেছি; যাতে তারা একে অন্যের দ্বারা কাজ নিতে পারে। আপনার প্রতিপালকের রহমত তো তারা যা (অর্থ-সম্পদ) সঞ্চয় করে, তা অপেক্ষা অনেক শ্রেয়।’ (সুরা যুখরুফ : ৩২)।

উপায় অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয় : বান্দার জন্য আল্লাহ কর্তৃক বরাদ্দকৃত রিজিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সে পাবেই। কাজেই এ ব্যাপারে একমাত্র তার ওপর ভরসা রাখতে হবে, তাওয়াক্কুল করতে হবে। সেই সঙ্গে সাধ্যানুযায়ী উপায়-উপকরণও অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উপায় অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়। কেননা, আল্লাহতায়ালার শ্বাশ্বত রীতি হচ্ছে, তিনি সাধারণত উপায়-উপকরণের পর্দার আড়ালে রিজিক দিয়ে থাকেন। তাওয়াক্কুল যেমন তার অকাট্য হুকুম, তেমনি উপায় অবলম্বনও তার অমোঘ বিধান। তাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা মানে তার আদেশ অমান্য করা। এর ফলে অভাব ও সংকট দেখা দিলে তা তার আদেশ অমান্য করারই পরিণাম। মোমিনের হৃদয়ে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকতে হবে যে, উপায় অবলম্বন ফলপ্রসূ হবে মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই। এসবের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই যে, তা অবলম্বন করলে রিজিক প্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী, অন্যথায় অপ্রাপ্তি অনিবার্য। এজন্য কখনও কখনও যাবতীয় উপায় অবলম্বনও ভেস্তে যায়, আবার কখনও উপায় ছাড়াই কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়। তাই একদিকে যেমন যথাসাধ্য উপায় অবলম্বন করতে হবে, অন্যদিকে আল্লাহতায়ালাই মূলদাতা- এ বিশ্বাসের সঙ্গে তার ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুলও করতে হবে। রিজিক অন্বেষণের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর। আর বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর; যাতে সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। কোরআন মাজিদের পরিভাষায় আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান দ্বারা ব্যবসা বা অন্য কোনো উপায়ে জীবিকা উপার্জনকে বোঝানো হয়। (তাফসিরে তাওযিহুল কোরআন : ৩/৫০২)।

রিজিকের বিশ্বাসে মধ্যম পন্থা কাম্য : বাস্তব সত্য হলো, মানুষের রিজিক বণ্টিত, সুনির্ধারিত। এ ক্ষেত্রে মানুষ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির দুই প্রান্তিকতার শিকার। দুটিই সত্যচ্যুত, প্রত্যাখ্যাত ও বিভ্রান্ত। এদের একদল হচ্ছে বৈরাগ্যবাদী, আরেকদল বস্তুবাদী। বৈরাগ্যবাদীরা মনে করে, রিজিক যখন বণ্টিত, আমার কাছে রিজিক এমনিতেই চলে আসবে। কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। তারা নিজেদের দাবির পক্ষে রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিস দলিল হিসেবে পেশ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যদি সত্যিকারার্থে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর, তবে তিনি তোমাদের রিজিক দেবেন, যেমন পাখিদের রিজিক দেন। তারা সকালে ক্ষুধা নিয়ে বেরোয়, সন্ধ্যায় তৃপ্ত ও পরিতৃপ্ত হয়ে (নীড়ে) ফেরে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম : ৭৮৯৪)। একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসবে যে, মূলত এ হাদিস তাদের পক্ষে নয়, বিপক্ষে। পাখিরা তো নীড়ে বসে থেকে রিজিকের অপেক্ষা করে না, বরং তারা রিজিকের সন্ধানে দিক-দিগন্তে ছুটে যায়। রিজিক তালাশে যারপরনা-ই প্রচেষ্টা চালায়। ফলে তারা পরিতৃপ্ত হয়ে নীড়ে ফেরে। মনে রাখতে হবে, বৈরাগ্যবাদ তথা পরিবার-পরিজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পার্থিব সব আনন্দ ও বিষয়ভোগ পরিহার করে ইবাদতে লিপ্ত থাকা ইসলাম অনুমোদন করে না। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলতেন, ‘তোমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের ওপর কঠোরতা আনয়ন কোরো না, তাহলে আল্লাহও তোমাদের ওপর কঠোর বিধান চাপিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই অতীতে একটি জাতি তাদের নিজেদের জন্য কঠোরতা গ্রহণ করেছিল। ফলে আল্লাহতায়ালাও তাদের ওপর কঠোর বিধান চাপিয়ে দিয়েছেন। গির্জা ও পাদ্রীদের উপাসনালয়ে যে লোকগুলো আছে, ওরাও তাদের উত্তরাধিকারী।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯০৪)। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘বৈরাগ্য তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। আমি তাদের জন্য এ বিধান করিনি।’ (সুরা হাদিদ : ২৭)।

উপকরণের ওপর ভরসা নয় : বস্তুবাদীরা একমাত্র উপায়-উপকরণের ওপরই ভরসা করে থাকে। তারা বাহ্যিক উপকরণের বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। এ নির্বোধরা জানে না যে, উপকরণ নিজে নিজে যেমন অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না, তেমনি কোনো কাজ করার নিজস্ব শক্তিও নেই এর। প্রকৃতপক্ষে এমন একজন মহান শক্তিধর কর্তা আছেন, উপকরণের ওপর যার রয়েছে পূর্ণ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা। তিনি চাইলেই তা ফলপ্রসূ হয়, অন্যথায় নয়। তাইতো দেখা যায়, অনেক সময় দু’জন মানুষ একই সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। উভয়ই শক্তি-সামর্থ্য এবং মেধা ও বিচক্ষণতায় সমপর্যায়ের। একজনের ব্যবসায় উত্তরোত্তর উন্নতি হতে থাকে। কিছুদিন যেতে না যেতেই বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে যায়।

তার ঈর্ষণীয় সফলতা দেখে কোনো বড় কোম্পানি তাকে ডিলারশিপ দিয়ে যায়। অন্যদিকে অপর ব্যবসায়ী আগের অবস্থায় পড়ে থাকে কিংবা তার মূলধনও হাতছাড়া হয়ে যায়। তেমনিভাবে একই হাসপাতালে একই কক্ষে দুই রোগী। উভয়ের রোগ, ডাক্তার, ওষুধ, চিকিৎসা সব একই। একজন আল্লাহর হুকুমে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে; অন্যজন লাশ হয়ে পরপারে পাড়ি জমায়। এসব প্রজ্ঞাময়ের লীলাখেলা। তা বোঝার সাধ্য আছে কার! বিশ্বজগতে যা কিছু হয়, সব আল্লাহর হুকুমেই হয়। তাঁর হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও ঝরে না। তাঁর ইচ্ছার বাইরে একটি অণুও নড়ে না। সব বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে। মহান আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের কুঞ্জি। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। (কোনো গাছের) এমন কোনো পাতা ঝরে না, যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। মাটির অন্ধকারে কোনো শস্যদানা অথবা আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোনো জিনিস নেই, যা এক উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই।’ (সুরা আনআম : ৫৯)।

রবের বিস্ময়কর কারিশমা : চিন্তার বিষয় হলো, চাষিরা জমিতে শুধু বীজ বপন করে। ধীরে ধীরে সেই বিজ থেকে অঙ্কুরোদগম ঘটিয়ে তাকে চারা বানান কে? সময়ের পরিক্রমায় সেই চারাকে দৃষ্টিনন্দন গাছে রূপান্তরিত করেন কে? তা থেকে উপকারী ফল বা ফসল দান করেন কে? সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া এমন কেউ কি আছে, যে এসব অবাক করা কার্যক্রম আঞ্জাম দিতে পারে? তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি শক্ত মাটির পরতে পরতে অঙ্কুরকে লালন করে এমন বিস্ময়কর শক্তি দান করেন যে, তার কৃশ দেহের কোমল কিশলয় মাটির আবরণ ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করে এবং সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামল ক্ষেতের রূপ লাভ করে। তিনিই সেই অসীম সত্তা, যিনি মানুষের বপিত চারাগাছে চাঁদণ্ডসূর্যের কিরণ বিকিরণ করেন এবং সৃষ্টির উপযোগী স্বাদ, মিষ্টতা, পুষ্টি ও ভিটামিন যুগিয়ে থাকেন। তাকে আন্দোলিত বাতাসের ক্রোর যোগাড় করে দেন। আবার আকাশে ভাসমান মেঘের শামিয়ানা টানিয়ে রোদে ঝলসানো থেকে রক্ষা করেন।

পর্যাপ্ত বৃষ্টি বর্ষণ করে তার প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করেন। অবশেষে এক-একটি জমিতে সৃষ্টি করেন শত শত শীষ এবং এক-একটি দানা থেকে বের করেন হাজারো দানা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এসব অনস্বীকার্য বাস্তবতার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ, তোমরা জমিতে যা কিছু বোনো, তা কি তোমরা উদ্গত কর, না আমিই তার উদ্গতকারী? আমি ইচ্ছা করলে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারি। ফলে তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে যে, আমরা তো দায়গ্রস্ত হয়ে পড়লাম। বরং আমরা সম্পূর্ণ বঞ্চিত হলাম।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৬৩-৬৭)।