ফেরাউনের সোনার মুখোশ এখন প্রকাশ্যে

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৭ | অনলাইন সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

প্রাচীন বিশ্বের ৭টি আশ্চর্যের একটি- গিজার খুফুর পিরামিডের পাশেই আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে গেল গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম (জিইএম)। আধুনিক যুগের এক সাংস্কৃতিক বিস্ময় হিসেবে বর্ণিত এ জাদুঘরটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর হিসেবে পরিচিত হতে যাচ্ছে। হাজার বছরের প্রাচীন ফেরাউনের যুগ থেকে শুরু করে গ্রিক ও রোমান যুগের প্রায় এক লাখ প্রত্নবস্তু নিয়ে সাজানো এ বিশাল জাদুঘরে মিসরের সাত হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। মিসরবিদরা বলছেন, গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামের উদ্বোধন মিসরের দাবি আরও জোরালো করবে। বিশ্বজুড়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ মিসরীয় নিদর্শন, যেমন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত বিখ্যাত রোজেটা স্টোন যেন ফেরত আনা হয়। জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণ হবে কিশোর ফেরাউন তুতেনখামেনের সম্পূর্ণ সমাধি ও তাতে পাওয়া সব প্রত্নবস্তু। যা ১৯২২ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার আবিষ্কারের পর এবারই প্রথমবারের মতো একসঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। এ প্রদর্শনীর মধ্যে থাকবে তুতেনখামেনের সোনার মুখোশ, সিংহাসন ও রথসহ আরও হাজারো মূল্যবান নিদর্শন।

জাদুঘরের সাবেক প্রধান ও আন্তর্জাতিক মিসরবিদ সংঘের সভাপতি ড. তারেক তাওফিক বলেন, আমার লক্ষ্য ছিল পুরো সমাধির অভিজ্ঞতাকে একসঙ্গে তুলে ধরা। যাতে কোনো জিনিস গুদামে না থাকে বা অন্য কোথাও না যায়। দর্শকরা যেন ঠিক হাওয়ার্ড কার্টারের মতোই শত বছর আগের সেই মুহূর্তটি অনুভব করতে পারেন। প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এ বিশাল জাদুঘর কমপ্লেক্সটি বছরে ৮০ লাখ দর্শনার্থী দেখার সুযোগ পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এটি মিসরের পর্যটন খাতে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনবে, যা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। গিজার পর্যটক গাইড ও নবীন মিসরবিদ আহমেদ সিদ্দিক বলেন, আমরা আশা করি, গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম মিসরবিদ্যার এক নতুন সোনালি যুগের সূচনা করবে। নতুন জাদুঘরের পিরামিড-আকৃতির প্রবেশদ্বারটি যেন নিজেই এক প্রত্নবস্তু। ৫ লাখ বর্গমিটারের বিশাল জাদুঘরটি যা প্রায় ৭০টি ফুটবল মাঠের সমান। এর বাইরের দেয়ালে খোদাই করা আছে হায়ারোগ্লিফিক লেখা, আর স্বচ্ছ অ্যালাবাস্টার পাথর কেটে ত্রিভুজ আকারে সাজানো হয়েছে। এখানে রয়েছে দ্বিতীয় রামেসাসের তিন হাজার ২০০ বছর পুরোনো ১৬ মিটার দীর্ঘ ওবেলিস্ক ও তার ১১ মিটার উঁচু বিশাল মূর্তি; যা ২০০৬ সালে কায়রো রেলস্টেশন সংলগ্ন স্থান থেকে সরিয়ে আনা হয়। একটি বিশাল সিঁড়ির দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে প্রাচীন রাজা-রানিদের মূর্তি। ওপরের তলায় বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যায় গিজার পিরামিডগুলোর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ১৯৯২ সালে হোসনে মোবারকের শাসনামলে এ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে ২০০৫ সালে কাজ শুরু হয়। কিন্তু ২০১১ সালের আরব বসন্ত, আর্থিক সংকট, করোনা মহামারি ও আঞ্চলিক যুদ্ধের কারণে নির্মাণকাজ শেষ হতে বেশ সময় লেগে যায়।

মিসরের সাবেক পুরাতত্ত্বমন্ত্রী ও বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ড. জাহি হাওয়াস গণমাধ্যমকে বলেন, এটি ছিল আমার স্বপ্ন। আমি অত্যন্ত খুশি, অবশেষে এ জাদুঘর খুলে গেছে। এটি প্রমাণ করে, মিশরীয়রা নিজেরাই প্রত্নতত্ত্ব, সংরক্ষণ ও জাদুঘর পরিচালনায় বিদেশিদের সমান দক্ষ। তিনি আরও যোগ করেন, এখন আমি দুটি বিষয় চাই- প্রথমত, জাদুঘরগুলো যেন চুরি করা প্রত্নবস্তু কেনা বন্ধ করে। দ্বিতীয়ত, আমি চাই ৩টি নিদর্শন ফিরিয়ে আনা হোক। এগুলো হলো- ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রোজেটা স্টোন, ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামের ডেন্ডেরা জোডিয়াক ও বার্লিনের নেফারতিতির মূর্তি। ড. হাওয়াস এরইমধ্যে অনলাইনে আবেদন চালু করেছেন, যাতে লাখ লাখ মানুষ স্বাক্ষর করেছেন এ ৩টি নিদর্শন ফেরত চাওয়ার দাবিতে।

অভিযোগ রয়েছে, রোজেটা স্টোন ১৭৯৯ সালে ফরাসি বাহিনী আবিষ্কার করেছিল, পরে ব্রিটিশরা সেটি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসেবে দখল করে। আর ডেন্ডেরার হাতোর মন্দিরের ছাদে থাকা প্রাচীন মিশরীয় পাথরের রিলিফ ভাস্কর্যটি ১৮২১ সালে ফরাসিরা কেটে নেয়। নেফারতিতির মূর্তি এক শতাব্দীরও বেশি আগে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা অবৈধভাবে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। অন্য এক মিসরবিদ ড. মনিকা হান্না বলেন, এ জাদুঘর দেখিয়ে দিচ্ছে, মিসর এখন আনুষ্ঠানিকভাবে তার চুরি হওয়া নিদর্শন ফেরত দাবি করার জন্য প্রস্তুত।

ব্রিটিশ মিউজিয়াম অবশ্য জানিয়েছে, তারা এখনও পর্যন্ত মিসর সরকারের কাছ থেকে রোজেটা স্টোন ফেরত চাওয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পায়নি। জাদুঘরে কর্মরত মিসরীয় বিশেষজ্ঞরা তুতানখামেনের বিভিন্ন প্রত্নবস্তু, যেমন তার চামড়া ও কাপড়ের বর্ম অত্যন্ত যত্নসহ পুনর্র্নিমাণ করেছেন। মিসরের আইনে এমন সংরক্ষণ কাজ কেবল মিসরীয়দেরই করার অনুমতি রয়েছে। ড. তারেক তাওফিক বলেন, বিশ্বজুড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা আমাদের সংরক্ষণ কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছেন। এটি কেবল প্রাচীন মিসরের ইতিহাস নয়, আধুনিক মিসরের সক্ষমতারও প্রতীক। কারণ, এ জাদুঘরটি তৈরি করেছে মিসরই।