ইসলামে বিজয় দিবসের তাৎপর্য
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৫ | অনলাইন সংস্করণ
ইসলাম ডেস্ক

১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ থেকে এ দিনে মুক্তি লাভ করে বাংলার মানুষ। এ বিজয় শুধু আনন্দের নয়, পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তি লাভের বিজয়। পৃথিবীর সব ধর্ম-দর্শনে স্বাধীনতার অশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামেও রয়েছে স্বাধীনতার অপরিসীম গুরুত্ব। বিজয় এবং স্বাধীনতা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ নেয়ামত। ইসলাম চায়- সকল মানুষ যেন শান্তিপূর্ণ ও স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে। ইসলাম আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়, আমরা যেন আমাদের ভূখণ্ড তথা মাতৃভূমিকে অত্যধিক ভালোবাসি। এটাই আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.)-এর উত্তম আদর্শ।
তাই বলা যায়- দেশপ্রেম, রাষ্ট্রের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা হচ্ছে, মুসলমানদের চরিত্র। রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো সত্যিকার ঈমানদার গাদ্দারি করতে পারে না। সুতরাং এ দেশের বিজয় দিবস আমাদের গৌরব, আমাদের অহঙ্কার। ইসলামে বিজয় ও স্বাধীনতার তাৎপর্য অপরিসীম। স্বাধীনতার ইসলামি স্বরূপ হচ্ছে, মানুষ মানুষের গোলামি করবে না; বরং একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তার গোলামি করবে। এ লক্ষ্যে আমাদের মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু। দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত।
ইসলামে দেশপ্রেম : স্বদেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস। বিশেষত, মুসলমানদের প্রতিটি রক্ত-কণিকায়ই দেশপ্রেমের শিহরণ থাকা বাঞ্ছনীয়। মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো, তার ভূখণ্ড ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন দেশপ্রেমিকের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অত্যাচারী কাফেরদের কারণে স্বীয় মাতৃভূমি মক্কা নগরী ত্যাগ করে মদিনায় পাড়ি জমাচ্ছিলেন, তখন তার চোখে অঝোর ধারায় অশ্রু বয়ে যাচ্ছিল। তিনি মক্কার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘হে মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কাফেররা নির্যাতন করে যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনও আমি তোমাকে ত্যাগ করতাম না।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা : ২৬৩৫; তাফসিরে ইবনে কাসির : ৩/৪০৪)। অপরদিকে হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা নগরীকেও খুব ভালোবেসেছেন। কোনো সফর থেকে ফেরার সময় মদিনার সীমান্তে ওহুদ পাহাড় চোখে পড়লে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠত। তিনি বলতেন, ‘এই ওহুদ পাহাড় আমাদের ভালোবাসে এবং আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালোবাসি।’ (বোখারি : ২/৫৩৯; মুসলিম : ২/৯৯৩)।
স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই দেশপ্রেম : দেশপ্রেমের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ হলো- দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন ও একরাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে, কবর-হাশরের ফেতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে। ’ (মুসলিম : ১৯১৩)। তাই সত্যিকারের দেশপ্রেম স্বদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। স্বদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার শিক্ষা দেয়। অতএব, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা ও এ বিজয়কে অর্থবহ করতে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা, দেশ ও দেশের মানুষকে ভালো কিছু দেওয়ার মনমানসিকতা রাখা উচিত।
ইসলামি ইতিহাসে বিজয়ের রূপরেখা : আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযি (রহ.) তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখ করেন, দশম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি উষ্ট্রীর ওপর আরোহিত ছিলেন। তার চেহারা ছিল নিম্নগামী। আল্লাহর দরবারে বিনয়ের সঙ্গে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এ নামাজকে বলা হয় ‘বিজয়ের নামাজ’। এরপর তিনি হারাম শরিফে এসে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘হে মক্কার কাফের সম্প্রদায়! তেরো বছর ধরে আমার ওপর, আমার পরিবারের ওপর, আমার সাহাবিদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রুলার চালিয়েছ, এর প্রতিবদলায় আজ তোমাদের কি মনে হয়, তোমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা কঠিন অপরাধী। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনি আমাদের উদার ভাই, উদার সন্তান। আপনি আমাদের সঙ্গে উদারতা ও মহানুভবতা দেখাবেন। এটাই আমরা আশা করি।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি আজ তোমাদের সবার জন্য ইউসুফ (আ.)-এর মতো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। যাও, তোমাদের থেকে কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে না।’ (সুনানে বাইহাকি : ৯/১১৮)।
মুসলমানের বিজয়ের ধরন : প্রত্যেক জাতিরই বিজয় রয়েছে, মুসলমানেরও আছে। কিন্তু মুসলমানের বিজয় নানা দিক থেকে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র্য। চিন্তা-আদর্শ, মূল্যায়ন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কর্মপন্থাসহ সব দিক থেকেই ভিন্ন মাত্রা ও ভিন্ন রকমের। কোরআনে কারিমে বিজয়ের দুটি রূপ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে- এক. স্বার্থ ও সাম্রাজ্যবাদী বিজয়, দুই. কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী বিজয়। প্রথমটির ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রাজা-বাদশা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে, তখন তা বিপর্যস্ত করে। সেখানকার মর্যাদাবান লোকদের অপদস্থ করে।’ (সুরা নামল : ৩৪)। এ ধরনের যুদ্ধ ও যুদ্ধজয় যত দেশে হয়েছে, সেখানে কত জনপদ তছনছ হয়েছে, কত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে, কত নারীর সম্ভ্রম ভূলুণ্ঠিত করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বিনিময়ে মানবতা শাসক-প্রভুর বদল ও শোষণের পালাবদল ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এ কারণে বিজয়ের এ ধরনটি মানবতার বিজয় নয়, বরং নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বিজয়। বিজয়ের আরেক রূপের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে এরা নামাজ আদায় করবে, জাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর সব কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন।’ (সুরা হজ : ২২)। এ ধরনের বিজয় হচ্ছে সত্য ও আদর্শের বিজয়, মানব-মানবতা ও সততার বিজয়। মুসলিম হিসেবে আমাদের বিজয়ের গৌরববোধ থাকা উচিত। আর বিজয়ের দ্বিতীয় রূপটিই আমাদের আদর্শ ও মননে রাখা চাই। শুধু নীতিগত দিক থেকে নয়, বাস্তব ইতিহাসেও এ রূপটিই আমাদের বিজয়ের প্রকৃত রূপ।
বিজয় দিবসে মুসলমানের করণীয় : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা কর; তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল।’ (সুরা নাসর : ১-৩)। মহান রাব্বুল আলামিন বিজয় দিবসে তিনটি কর্মসূচি এ সুরায় ঘোষণা করেছেন। তা হলো- এক. ফাসাব্বিহ (আল্লাহর তাসবিহ পাঠ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করা), দুই. বিহামদি রাব্বিক (আল্লাহর হামদ তথা শোকরিয়া আদায় করা), তিন. ওয়াস্তাগফির (যুদ্ধের সময় ভুল-ভ্রান্তি তথা সীমালঙ্ঘন থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা)। স্বাধীনতা ও বিজয় একমাত্র মহান করুণাময় আল্লাহরই দান। আল্লাহর অশেষ করুণার বদৌলতেই আমরা এ দেশ বিজয় করতে পেরেছি। তাই শোকরিয়াও আদায় করতে হবে একমাত্র তাঁরই। আর হাদিস থেকে জানা যায়, বিজয় দিবসে আট রাকাত নামাজ আদায় করা, যুদ্ধে নিহতদের জন্য ইস্তেগফার-দোয়া ও কোরআন পাঠসহ বিভিন্নভাবে ইসালে সওয়াব করা কর্তব্য। কেননা, মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) দশ বছর পর শত-সহস্র সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর বিশাল বহর নিয়ে যখন পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি বিজয় মিছিল বা শোভাযাত্রার কিছুই করেননি; গর্ব-অহঙ্কার করেননি; বাদ্য-বাজনা বাজাননি; কারো সমাধি বা মিনারে পুষ্পস্তবকের আয়োজন করেননি; বরং তিনি একটি উষ্ট্রীর ওপর আরোহিত অবস্থায় চেহারা নিম্নগামী করে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। এরপর সর্বপ্রথম তিনি উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করে আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এতে বিজয় দিবসে মহান আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে এভাবে নফল নামাজ আদায় করা ইসলামের শিক্ষা বলে পরিগণিত হয়।
