অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে দেশ। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তথ্য ও প্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রেই ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এসবই হয়েছে গত ৫০ বছরের মধ্যে। এপথ ছিল বন্ধুর ও পিচ্ছিল ছিল আরও অনেক বাধাও। সব বাধা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিম্ন, নিম্ন-মধ্যম ও মধ্যম আয়ের দেশের গণ্ডি পার হয়ে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার অপেক্ষায় দেশ। দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করতে পারে এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনার কথা প্রথম বলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যদিয়েই দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সূচনা। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়া, মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা, নারী জাগরণ কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে সবসময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্ভীক। সাধারণ জনগণ, পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় আনতে গ্রহণ করেন নানা পদক্ষেপ। তার উন্নয়ন ভাবনায় প্রস্ফুটিত হয় ভবিষ্যৎ বিকাশের রেখা- এমনটাই মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আত্মনির্ভর অর্থনীতি বিনির্মাণের ইতিহাসে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেয়ায় অনেক এগিয়ে গেছে, বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক স্বপ্ন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দেশে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। দেশের প্রায় সব উন্নয়ন হয়েছে গত ১১ থেকে ১২ বছর ধরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায়। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। পৃথিবীর কাছে অনন্য এক উদাহরণ। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এ তিন সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ আজ তিন সূচকেই তার মানদণ্ডে উন্নীত।
এদিকে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশ আট ধাপ এগিয়ে বিশ্বের ৮০তম দেশ হয়েছে। মুজিববর্ষে ৬ লাখ ৮ হাজার দুস্থ পরিবারকে পাকাবাড়ি তৈরি করে দেয় শেখ হাসিনার সরকার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম দেশ বাংলাদেশ ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করেছে। জাতির জন্য মুজিববর্ষে এগুলো শ্রেষ্ঠ উপহার।
দেশের উন্নয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। স্বাধীনতার সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পাকিস্তান এগিয়েছিল। আজ ৫০ বছর পর প্রায় প্রতিটি সূচকেই তারা বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। এটিই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় এ দেশের অর্থনীতিকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। আমার বিশ্বাস, সেই কিসিঞ্জার যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিই এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে বিস্মিত হতেন। এখন আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করে বলতে পারি সেই তলাবিহীন ঝুড়ি আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের এক রোল মডেল।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ অভূতপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনীতি ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রেই উন্নয়ন হচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে প্রতিবেশী দেশগুলো বিস্মিত। পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সদস্য বলেছেন, সুইজারল্যান্ড পরের কথা, আগে বাংলাদেশ হও। এ কী আমাদের উন্নয়ন না। যারা আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করেছে। যাদের আমরা তাড়িয়ে দিয়েছি। তারা আমাদের কাছে আসছে, অনুসরণ করছে। বঙ্গবন্ধুর কারণেই আজকে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি। এ উন্নয়ন ধরে রাখতে আমাদের কী কী করা দরকার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন ধরে রাখার পূর্বশর্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্ট্যাটাস মেনটেইন করতে হবে। পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি সবচেয়ে বড় জিনিস। উন্নয়নের আরও একটি কারণ হলো- গত ১১ থেকে ১২ বছর ধরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে বলেই দেশের উন্নয়ন হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, স্বাধীনতার পর অর্থনীতির মুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। যে কথাটা প্রচলিত ছিল সেটা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তখন সাড়ে ৭ কোটি জনগণের স্থলে এখন ১৭ কোটি জনগণ। রেমিট্যান্স বেড়েছে, রপ্তানি বেড়েছে, বেড়েছে কর্মসংস্থান। এগুলোই প্রমাণ করে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আরও উন্নয়ন হতো যদি আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকত। দেশে যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত ও টেকসই হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে। তিনি চেয়েছিলেন, ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সে ধারাবাহিকতা রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ অর্থনীতির সমিতির (বিইএ) সাধারণ সম্পাদক, অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ, এফসিএ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে বাণিজ্য ছাড়া বিকল্প নেই। ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হবে। বিজনেস পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘অর্থনীতির প্রত্যাশা কিছুটা তো পূরণ হয়েছেই।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আইএমএফসহ সব দাতা সংস্থা বাংলাদেশ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিচ্ছে, তাতে একটি বার্তা পরিষ্কার, দেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় আছে। এটি আশাবাদী হওয়ার মতো। পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া সঠিক পথেই আছে বলে জানান তিনি।
যেভাবে বদলেছে অর্থনীতি : স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের মাইলফলক স্পর্শ করতে চলেছে বাংলাদেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির খেতাব পাওয়া ছোট্ট বদ্বীপটি আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। অর্থনীতির আকার ৩০০ বিলিয়ন ডলার। প্রতিযোগী এবং পার্শ্ববর্তী অনেক দেশকে পেছনে ফেলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এখন ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই সময় জিডিপির আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। ৫০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসাবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপি আকার ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ টাকা বা ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা বা ২৫৯১ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ। কৃষিতে আমাদের অগ্রগতির বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি, তৈরি পোশাক, আইটি, চামড়াজাত পণ্য, পোলট্রি, গবাদিপশু ও মৎস্য চাষেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও যান্ত্রিকীকরণকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল। রপ্তানি আয় বাড়ছে, রপ্তানি পণ্যে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পণ্য। বর্তমানে বিশ্বের ১৯২টি দেশে বাংলাদেশ ৬৯২টি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন। এ সেতু ও মোংলা বন্দর দিয়ে প্রথমবারের ন্যায় গার্মেন্ট পণ্য পোল্যান্ডের পথে গত ২৮ জুলাই যাত্রা শুরু করে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গতি যোগ করতে দেশে গড়ে উঠছে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এরই মধ্যে ১৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল প্রকল্প, পায়রা বন্দর দেশের অর্থনীতিযোগ করেছে নতুন মাত্রা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র , মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প অর্থনীতিকে অনেক দূর এগিয়ে নিচ্ছে। দেশের উৎপাদিত ওষুধ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণসহ প্রায় ১০০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ১০০ প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, তাতে ২০২৩ সালের আগেই দারিদ্র্য হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) বিচারে ২০২০ সালে মহামারির মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে গণতন্ত্রের পরিসর সংকীর্ণ হলেও বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের তুলনায় এগিয়েছে। গণতন্ত্র সূচকে আট ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। পাঁচটি মানদণ্ডে একটি দেশের গণতন্ত্র পরিস্থিতি বিচার করে ইআইইউ সম্প্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের চার ধাপ উন্নতি হয়েছে। ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর নিয়ে ইআইইউর গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ এবার রয়েছে ১৬৫টি দেশ ও দুটি অঞ্চলের মধ্যে ৭৬তম অবস্থানে।
২০২০ সালের এই সূচক বলেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক (৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ) এখন গণতন্ত্র অথবা আংশিক গণতন্ত্র ভোগ করছে। এর মধ্যে পূর্ণ গণতন্ত্র উপভোগ করছে মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ যার জিডিপি আকার ২০১৯ সালে ৩১৭.৪৭৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় যার ৯০ ভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও ৯৭ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশনের আওতায় এসেছে।
বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এবং সংশ্লিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (২০১০-২০২০), বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্তকরণ, অষ্টম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শুরু ইত্যাদি সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজের সাক্ষর। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৩ শতাংশ, দারিদ্র্য হার ২১.৮ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ নিচে, শিশুমৃত্যুর হার ১২ জন, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১০৫, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ, গড় আছু ৭২ বছর, চাল উৎপাদনে বিশ্বের চতুর্থ স্থান, মাছ ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থান ইত্যাদি, যা দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ শতাংশ বা এর কম, যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মাত্র ৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যে দেশ, তা আজ ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। যা জিডিপি’র ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। শুধু বাজেট কেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি, মাথাপিছু আয় ও মানবসম্পদ সূচকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে আসছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী পিপিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ৩০তম। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারসের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে ২৩তম স্থান দখল করবে। এইচবিএসসির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে, ২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৩ দশমিক ৫। ২০১৮ সালে তা ১০ দশমিক ৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাদের হিসাব- ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো থেকে এগিয়ে থাকবে।
হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন এইচএসবিসির গ্লোবাল রিসার্চের তথ্য মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ, বর্তমানে যেখানে ৪২তম। ‘দি ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০ : আওয়ার লং টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে, যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অধিক, যা ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার উপরে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ১৯৭৬-৭৭ সালে মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার দিয়ে শুরু হলেও ২০০৮-০৯ সালে রেমিট্যান্স আসে ৯ হাজার ৬৪৯ মিলিয়ন ডলার। ১৯৭৬ সালের উপার্জিত রেমিট্যান্সের তুলনায় যা প্রায় ১৯৮ গুণ বেশি। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের মতো একই বৈশ্বিক প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। তাছাড়া উন্নয়শীল দেশগুলোয় সম্পদ হস্তান্তরের বা উপার্জিত আয় দেশে প্রেরণের বিশেষ সুবিধা বিদ্যমান।
উন্নত দেশগুলোতে যা সীমিত। রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারের নয়, সেবা খাতসহ ওটা ৬০ বিলিয়ন ডলারের। আমাদের পণ্য খাতের রপ্তানি হয়েছে ৫২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা খাতে গত জুন পর্যন্ত গড়ে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন হয়েছে। সুতরাং, ৬০ বিলিয়নের বেশি। কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছিল, ২০২১ সালে ৬০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হবে এবং তার মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার আসবে গার্মেন্ট থেকে। ২০২২ সালে এসে ৬০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করল বাংলাদেশের রপ্তানি। এটি একটি বিশাল ঘটনা। তার মধ্যে ৪২ বিলিয়ন আসছে গার্মেন্ট থেকে। বাকিগুলো আসছে সেবাসহ অন্যান্য খাত থেকে। এ গতি অব্যাহত রেখে আমরা আশাবাদী যে ২০২৪ সালে ৮০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। আরও চার খাতে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হয়েছে। বিশেষ করে হোম টেক্সটাইলে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন। চামড়াজাত পণ্যও রয়েছে। আরও আছে অ্যাগ্রো প্রসেসিং। এই সবগুলোকে যদি আমরা অন্তত ৫ বিলিয়নে নিয়ে যেতে পারি, সেক্ষেত্রে আমাদের ভালো সম্ভাবনা আছে। আমরা একটা এক্সপোর্ট পাওয়ার হাউজ হিসেবে এ অঞ্চলে গণ্য হতে পারব।
গত পাঁচ দশকে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। গ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে তা দৃশ্যমান। ২০০০ সালে আমাদের প্রবাসী আয় বেড়ে পৌঁছে ১ হাজার ৯৫৪ দশমিক ৯৫ ডলারে। ২০১৯ সালের, যা ছিল ১৮ হাজার ৩৫৪ দশমিক ৯৪ ডলার। এরপর থেকে বাড়তেই থাকে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯৭২ সালে শতকরা ৪৮.৮, ১৯৮০ সালে ৪৪.২, ১৯৯০ সালে ৩৭.৬, ২০০০ সালে ১৯.৫১, ২০১০ সালে ১৪.৫ ও ২০২০ সালে ১২.০৮ ভাগ আসে কৃষি ও তৎসংশ্লিষ্ট খাত থেকে। সমতল ভূমির মোট জমির ৯২ শতাংশ ব্যবহার হয় কৃষিকাজে আর কৃষিকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে ৬৪ শতাংশ মানুষ। কৃষিপণ্যের রপ্তানি ছুঁয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক।