সিএনএনের প্রতিবেদন:

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চায় বাংলাদেশ, বড় বাধা ভারত

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৩২ | অনলাইন সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে—মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এমনটাই জানিয়েছে।

গত শনিবার (২২ নভেম্বর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি একজন বিপ্লবী নেতার কন্যা। ১৯৭০-এর দশকে তার বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডই তার রাজনৈতিক উত্থানকে পরবর্তী সময়ে সংজ্ঞায়িত করেছে। তবে তার ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানো শেষ পর্যন্ত নাটকীয়ভাবে শেষ হয়, যার ফলে তাকে ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে যেতে হয়।

শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়েছে, যা কার্যকর হতে পারে—যদি নয়াদিল্লি তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

ক্ষমতাচ্যুত এই নেত্রীকে ২০২৪ সালে ছাত্র আন্দোলন দমনের সময় সংঘটিত সহিংসতার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১৫ বছরের ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর গত আগস্টে তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখানে আশ্রয় নেন এমন একটি দেশের রাজধানীতে, যা তার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত।

বর্তমানে তিনি দুই দেশের মধ্যে একটি টানটান কূটনৈতিক পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন, কারণ ঢাকা তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাচ্ছে। যদিও শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, এই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তিনি তা করেননি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, “জনতার রোষ থেকে বাঁচতে তাকে পালাতে হয়েছে। ভারতে তিনি আত্মগোপনে আছেন, আর সেখানে বসেই মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত—এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।”

শেখ হাসিনার রাজনৈতিক যাত্রা যেন শেক্সপীয়রীয় একটি গল্প—ট্র্যাজেডি, নির্বাসন এবং ক্ষমতার দীর্ঘ ইতিহাস, যা তার দেশের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজনীতির ভেতরে বড় হয়েছেন। তবে ১৯৭৫ সালের আগস্টে এক রক্তাক্ত রাত তার জীবন সবচেয়ে বেশি বদলে দেয়।

সেদিন সেনাবাহিন্যের কিছু সদস্য তার বাবা, মা এবং তিন ভাইকে হত্যা করে। সে সময় শেখ হাসিনা ও তার বোন পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। অরাজকতার সেই সময়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন, যিনি ভবিষ্যতের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার স্বামী ছিলেন। জিয়াউর রহমানের সরকার একটি আইন পাস করে, যার মাধ্যমে হত্যাকারীদের কয়েক দশক ধরে সুরক্ষা দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনার জীবন ওই এক রাতেই পাল্টে যায়। তিনি ছয় বছর ভারতে নির্বাসিত থাকেন, যা তার মধ্যে ভারত রাষ্ট্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জন্মায়। ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন, যা পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ তৈরি করে। নিজের নির্বাসন থেকে ফেরার দিনটি স্মরণ করে তিনি বলেছেন, “বিমানবন্দরে নেমে কোনো আত্মীয়কে পাইনি, তবে পেয়েছিলাম লাখো মানুষের ভালোবাসা—এটাই আমার শক্তি।”

এরপর শুরু হয় ‘বিদ্বেষী বেগমদের’ যুগ—দুই নারীর মধ্যে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, যা পরবর্তী ৩০ বছর ধরে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করেছে।

বাবার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের মধ্যে তাকে গৃহবন্দিত্ব ও দমন-পীড়ন মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রধান ঘোষণা ছিল ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করা।

ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার অনুসারী শেখ হাসিনা এক মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হারালেও ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আরও কঠোর ও দৃঢ় মনোভাব নেন। পরবর্তী ১৫ বছরে তিনি শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যুগের সূচনা করেন এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন।

বাংলাদেশের উন্নয়নের সাফল্যের সঙ্গে তিনি এবং তার সরকার একদলীয় ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল। ভারতীয় সংবাদপত্র ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ উল্লেখ করেছে, পরিস্থিতির চাপ বাড়লেও শেখ হাসিনা ভারতের ওপর পূর্ণ নির্ভর করতে পারতেন।

তবে দেশের অভ্যন্তরে তার প্রশাসন ক্রমাগত কঠোর ও দমনাত্মক নীতির জন্য সমালোচিত হয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেছেন, “ক্ষমতায় থাকতে তিনি অনেক রক্ত ঝরিয়েছেন।”

জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও গত বছরের তরুণদের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থান তার সরকারের জন্য ভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রুত পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার নৃশংস দমন-পীড়ন চালায়, যার ফলে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হন।

আন্দোলন থামেনি, বরং তা আরও বিস্ফোরিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত তার সরকারকে উৎখাত করে। মোবাশ্বার হাসান বলেন, “তাকে পালাতে হয়েছিল। এটি নিজেই অপরাধের স্বীকারোক্তি—জনগণ ও বিভিন্ন বাহিনী তার বিরুদ্ধে ছিল।”

ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনার বর্তমান জীবন তাকে আবার পুরোনো নির্বাসনের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার অনুপস্থিতিতে বিচার সম্পন্ন করেছে এবং মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আদালতের অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল—বিক্ষোভ দমন, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার, ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার এবং বিক্ষোভকারীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ।

আদালত স্থির করেছে যে তিনি ছাত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা হতেই আদালতকক্ষে করতালি ও আবেগ প্রকাশের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনে নিহত এক শিক্ষার্থীর বাবা বলেন, “এই রায়ে কিছুটা শান্তি পেলাম, সম্পূর্ণ শান্তি পাবো তার ফাঁসির মধ্য দিয়ে।”

ভারতেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান আছে, তবে দেশটি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সকল পক্ষের সংলাপে যুক্ত থাকার অঙ্গীকার করেছে। শেখ হাসিনার পরিবার ভারতের সহায়তা প্রশংসা করেছে। তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বলেছেন, “ভারত সবসময় আমাদের বন্ধু। এই সঙ্কটে তারা আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।”

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা ভারতের অন্যতম আঞ্চলিক মিত্র ছিলেন। বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে তার সরকার ভারতবিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল। তবে তার পতনের পর নয়াদিল্লিতে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সক্রিয়তার সম্ভাবনা নিয়ে।

ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়েত জানিয়েছেন, নয়াদিল্লি শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠাবে বলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা এখনো সব আইনি প্রতিকার ব্যবহার করেননি এবং প্রতিকার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাড়াহুড়ো করা হবে না।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করতে পারে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও নেতৃত্ব ভেঙে পড়ায়, নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে বিভক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের করার দায়িত্বে আছে।

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এবং অন্যান্য ছোট দলের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিভেদ সহজে মুছে যাবে না। মোবাশ্বার হাসান বলেন, “বাংলাদেশ এখন মিলেমিশে থাকার অবস্থার কাছাকাছি নয়।”

শেষে প্রশ্ন হচ্ছে—শেখ হাসিনার বিদায় কি এক বিষাক্ত যুগের সমাপ্তি আনবে, নাকি নতুন অনিশ্চয়তার সূচনা মাত্র হবে।