বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহ যত ভূমিকম্প
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:০৪ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্পের কারণে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে অসংখ্য ভবন। কোটি কোটি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার অবকাঠামোগত ক্ষতি, জীবনহানি এবং জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
উত্তর আমেরিকা- জানুয়ারি ১৭০০ : উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তবে এর কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প মনে করা হয় এটিকে। এ ভূমিকম্পের পর সুনামিতে ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের পাচেনা উপকূলের অধিবাসীদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
পর্তুগাল- নভেম্বর ১৭৫৫ : ১৭৫৫ সালের ১ নভেম্বর পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৭। শহরটির প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এ ভূমিকম্পে।
ইকুয়েডর- জানুয়ারি ১৯০৬ : এ বছরের ১৩ জানুয়ারি ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার সমুদ্র উপকূলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পর সৃষ্টি হওয়া সুনামিতে নিহত হয় ৫০০-এর বেশি মানুষ।
জাপান- সেপ্টেম্বর ১৯২৩ : সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ বিকেলে জাপানে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৯ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। এ ভূমিকম্পে টোকিও ও ইয়োকোহামার মতো নগরে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। এ ভূমিকম্পের পর একটি সুনামি হয়েছিল, যার উচ্চতা ছিল ৪০ ফুট পর্যন্ত। ভূমিকম্প ও এতে সৃষ্ট সুনামির পরে টর্নোডোও হয়েছিল। সরকারি হিসেবে তাতে ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। এতে ইয়োকাহামার ৯০ শতাংশ ভবন এবং টোকিও পাঁচ ভাগের দুই ভাগ এলাকা ধ্বংস হয়েছিল।
চিলি- মে ১৯৬০ : বিশ্বের যেসব ভূমিকম্পের ইতিহাস পাওয়া যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প ছিল ১৯৬০ সালের মে মাসে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে অবস্থিত দেশ ‘চিলি’তে। রিখটার স্কেলে সেই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫। ভূমিকম্পের পর ৩০ ফুট উচ্চতার একটি সুনামি হয়। ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রাণ হারান ২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া ১৮৬৮ সালের ১৩ আগস্ট প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট ৯ মাত্রার ভূকম্পন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত অনুভূত হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার আরেকুইপা শহর। সেখানে অন্তত ২৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল।
রাশিয়া- নভেম্বর ১৯৫২ : এ বছরের ৪ নভেম্বর রাশিয়া ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্টি হয় সুনামি। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল কামচাটকা উপদ্বীপ। তিন হাজার মাইলজুড়ে অনুভূত হয়েছিল এ ভূকম্পন। এতে নিহতের তথ্য পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র- মার্চ ১৯৬৪ : যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চে ৯ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ফলে আলাস্কায় ভয়ংকর ভূমিধস ও সুনামির সৃষ্টি হয়। এতে ১২৮ জন নিহত হয়। এ ছাড়া ৩১ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়।
আফগানিস্তান- মে ১৯৯৮ : এ বছর কয়েক মাসের ব্যবধানে আফগানিস্তানে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় দুটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রথম ভূমিকম্পটি তাখার প্রদেশে ফেব্রুয়ারি মাসে আঘাত হানে। এ ভূমিকম্পে ২ হাজার ৩০০ মানুষ প্রাণ হারায়। কারও কারও মতে, ৪ হাজার মানুষ মারা যান। এর তিন মাস পর মে মাসে আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৬। এ ভূমিকম্পে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েক হাজার মানুষ।
ইন্দোনেশিয়া- ডিসেম্বর ২০০৪ : উত্তর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে এ বছরের ২৬ ডিসেম্বরে একটি ৯ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ফলে সৃষ্ট সুনামিতে অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। অনেক লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার ১৪টি দেশে অনুভূত হয়েছিল এ ভূমিকম্প ও সুনামি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। দেশটির মৎস্য শিল্প ও কারখানার প্রায় ৬০ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যায় এ সময়।
কাশ্মীর- মে ২০০৫ : ভারত ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর উপত্যকা শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। এ ভূমিকম্পে উপত্যকার ৭৫ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। গৃহহীন হয়েছিল ১০ লাখের বেশি মানুষ। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় উদ্ধার অভিযান চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।
চীন- মে ২০০৮ : সিচুয়ান প্রদেশে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প। এতে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গৃহহীন হয়ে পড়ে আরও প্রায় এক কোটি মানুষ। ভূমিকম্পের আঘাতে কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়ে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখনকার হিসেবে, সেই ভূমিকম্পে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সম্পদ নষ্ট হয়েছিল। ভূমিকম্পের সময় স্কুলে ছিল এমন ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ভূমিকম্পের ফলে ভবন ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে এসব শিশু প্রাণ হারিয়েছিল। এর আগে ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান ভারতের আসাম ও চীনের তিব্বতে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পে আসামণ্ডতিব্বতের ৭০টি গ্রাম ধবংস হয়ে যায়। নিহত হয় হাজার হাজার মানুষ। ভূমিকম্পের পরে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। এ ছাড়া ১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে চীনের শানশি ও আশপাশের প্রদেশ কেঁপে ওঠে। ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচনা করা হয় এটিকে। এ ভূমিকম্পে আনুমানিক ৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষের নিহত হয় বলে জানা যায়।
হাইতি- জানুয়ারি ২০১০ : ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতির রাজধানী পোর্ট-অপ্রিন্সে ৭ মাত্রার শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয় পোর্ট-অপ্রিন্স। নিহত হয় ৩ লাখ ১৬ হাজারের মতো মানুষ। ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল, হাইতির প্রতিবেশী দেশ কিউবা ও ভেনেজুয়েলাতেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। এ ভূমিকম্পের পর ধ্বংসযজ্ঞে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক হিসেবে, এ ভূমিকম্পে পোর্ট-অপ্রিন্স ও এর আশপাশের এলাকার ৮০ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছিল। বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস জানা যায়, হাইতিতে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এ ভূমিকম্পকে সবচেয়ে ভয়াবহ ধরা হয়।
জাপান- মার্চ ২০১১ : জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে দেশটিতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। ২০১১ সালের মার্চে জাপানে ৯ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পের পর আঘাত হানে সুনামি। ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রায় ১৯ হাজার মানুষ নিহত হন। আহত হন আরও ৬ হাজার। এ ভূমিকম্পের ফলে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিপর্যয় ঘটে। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের পর এটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক পারমাণবিক বিপর্যয়ের ঘটনা।
পাকিস্তান- সেপ্টেম্বর ২০১৩ : এ বছর পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে পরপর দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। একটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭, অপরটির ৬ দশমিক ৮। মূলত ভূমিকম্প হয় প্রদেশটির আওরান জেলায়। তবে রাজধানী ইসলামাবাদ ছাড়াও রাওয়ালপিন্ডি, করাচি, লাহোর, লারকানার মতো বড় বড় শহরগুলোয়ও ভূকম্পন অনুভূত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের বাইরে ভারতের নয়াদিল্লি এবং ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে ওমানের রাজধানী মাসকাটেও ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। এ ভূমিকম্পে বেলুচিস্তানের অসংখ্য গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে কমপক্ষে ৮২৫ জন প্রাণ হারান। আহত হন এক হাজারের বেশি। এ ছাড়া বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়।
নেপাল, এপ্রিল ২০১৫ : এ ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ১৯৩৪ সালের পর নেপালে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প ছিল এটি। এ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে এটি একটি। ভূমিকম্পে নেপালে ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে যায়। এতে প্রায় ৯ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় ২১ হাজার। ধ্বংস হয় ৮০ শতাংশ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা।
হাইতি, আগস্ট ২০২১ : এ বছরের ১৪ আগস্ট সকালে ৭ দশমিক ২ মাত্রার শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে হাইতি। ধসে পড়ে অসংখ্য বাড়ি, স্কুল ও হাসপাতাল। প্রাণ হারান কয়েকশ’ মানুষ। দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি পড়ে সংকটে। ২০১০ সালের ভূমিকম্পের পর এটাকে হাইতির সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলা হতো।
আফগানিস্তান, জুন ২০২২ : এ বছরের জুনে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ১। এ ভূমিকম্পে অন্তত ১ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন দেড় হাজার। ভূমিকম্পে পাকতিকা প্রদেশে অনেক জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো বা আংশিক ধসে পড়ে সাড়ে চার হাজার বাড়ি।
তুরস্ক ও সিরিয়া- ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : পৃথিবীর সর্বশেষ ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। এটি তুরস্ক-সিরিয়ায় অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। উৎপত্তি তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ অঞ্চলে। এ ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ঘুমাচ্ছিলেন সীমান্তের দু’দিকে তুরস্ক ও সিরিয়ার বাসিন্দারা। এ সময় শক্তিশালী এক ভূমিকম্প আঘাত হানে ওই জনপদে। ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। ভূমিকম্পের পরে আরও অর্ধশতবার পরাঘাত অনুভূত হয়। ভূমিকম্পে দুই দেশের সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। বহু মানুষ নিখোঁজ হন। অসংখ্য ভবন ও অবকাঠামো ধসে পড়ে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপ। এ ভূমিকম্পে ১০টি শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হয়। এগুলো হলো- গাজিয়ানতেপ, কাহরামানমারা, হাতায়, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানিলুফরা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস। ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তুরস্ক ও সিরিয়া ছাড়াও লেবানন ও সাইপ্রাস এমনকি তুরস্ক থেকে বহু দূরে থাকা ডেনমার্কের গ্রিনল্যান্ডে ভূকম্পন অনুভূত হয়।
