অনভিজ্ঞ রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘কঠিন পরীক্ষায়’ ইসি
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:০৪ | অনলাইন সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা অধিকাংশ কর্মকর্তাদের আগের কোনো জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নেই। ফলে এবারের নির্বাচন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ স্তর- প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের অনেকেরই নেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজ করার বাস্তব অভিজ্ঞতা। ফলে ভোটগ্রহণের দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যালট ও ইভিএম ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
জানা গেছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সব জেলায় জেলা প্রশাসক পদে পরিবর্তন করা হয়েছে। তারা নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। ফলে ডিসি পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুই রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে।
জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শাসন আমলে যারা মাঠপ্রশাসনে ছিলেন ডিসি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে প্রশাসন ক্যাডারের পরিবর্তে প্রশাসন ক্যাডারে যুক্ত করানো বিলুপ্ত অর্থনীতি ক্যাডারের কর্মকর্তারা বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। তাদের অনেকেরই মাঠপ্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকার সমালোচনা তৈরি হয়েছে। তবে, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কর্মজীবনের শুরুতেই ম্যাজিস্ট্রেট ও এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) হিসেবে কাজ করার করার মধ্য দিয়ে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে শুরু করেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়ে মাঠপর্যায়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন।
ইসি সূত্র বলছে, নির্বাচনে অধিকাংশ জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ডিসিরা দায়িত্ব পালন করলেও কয়েকটি জেলায় ইসির আঞ্চলিক বা সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে যেসব জেলায় সংসদীয় ৫ আসনের বেশি রয়েছে, সেসব জেলায় ইসির কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। ইসির কর্মকর্তারা থাকলেও মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ক্ষমতার কারণে ডিসিদের বেশি যোগ্য দেওয়া হবে। তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে একটি ‘মিশ্র মডেল’ দেখা যেতে পারে। ইসির কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তারা দায়িত্ব পেলে ভালো হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ তাদের আগের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে।
আইন অনুযায়ী, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কারা নিয়োগ পাবেন, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজের যেকোনো যোগ্য ব্যক্তিকেই এই পদে নিয়োগ দিতে পারে। স্থানীয় নির্বাচনে ইসির কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করলেও, জাতীয় নির্বাচনে বহু বছর ধরেই ডিসিদের ওপরই নির্ভর করে আসছে নির্বাচন কমিশন।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও মাঠপ্রশাসনের অভিজ্ঞতা ছাড়া কাউকে ডিসি করলে সেটি ভালো নির্বাচনে সহায়ক হবে না। সরকার যে ধরনের নির্বাচন চাইবে, ডিসি-ইউএনও যাকেই করা হোক তিনি সেই ধরনের নির্বাচনই উপহার দেবেন। রাজনীতিকরা ভালো নির্বাচন না চাইলে কেউই তা করতে পারে না।
ফিরোজ মিয়া বলেন, মাঠ প্রশাসনে অভিজ্ঞতা নেই এবং নির্বাচনের কাজে কখনও সংশ্লিষ্ট ছিল না, এমন কাউকে জেলা প্রশাসক নিয়োগ করা হলে তিনি নির্বাচনে খুব একটা ভালো অবদান রাখতে পারবে না। বরং তার দ্বারা সমস্যা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। নির্বাচনে অনেক ধরনের ‘খেলোয়াড়’ থাকে। নির্বাচনের খেলা ও খেলোয়াড়দের ট্যাকেল করার দক্ষতা মাঠপ্রশাসন বা নির্বাচনি কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে তৈরি হয় না।
রাজনীতিবিদ ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, অনভিজ্ঞতার কারণে ছোট একটি ভুলও বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে। এতে ভোটের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দৃঢ় প্রশাসনিক মনোভাব ও কঠোর নজরদারি অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে এবারের নির্বাচন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ জোরদার করা হয়েছে এবং মাঠপর্যায়ে তদারকি বাড়ানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের সংসদ নির্বাচনগুলোর তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনর। বিশেষ করে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার হিসেবে যারা নিয়োজিত থাকছেন, তাদের অনেকেরই আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। এতে করে ভোটগ্রহণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন পর্যবেক্ষকরা। প্রশাসনিক দুর্বলতা থাকলে নির্বাচনি পরিবেশ যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, তেমনি ভোটের স্বচ্ছতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও বিষয়টি নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। অনেক দলই দাবি করছে, অভিজ্ঞতার অভাব যেন নির্বাচনকে প্রভাবিত না করে- এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মাঠপর্যায়ে ডিসি থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় নির্বাচন করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। নির্বাচনের জন্য নিঃসন্দেহে ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। এরপরও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- তারা জাতীয় নির্বাচন করতে প্রস্তুত, এখানে সততা ও সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই- এবার সফলতম নির্বাচন হবে।
তিনি আরও বলেন, সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক বর্তমানে দুটোপক্ষ (বিএনপি-জামায়াত) শক্তিশালী অবস্থায় আছে, নির্বাচনে এককভাবে কেউ আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। ফলে নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব নাও হতে পারে, আবার দু’পক্ষই যদি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দুটো শঙ্কা রয়েছে। একইসঙ্গে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও নির্বাচন কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা করতে পারে। সুতরাং সংঘাত-সহিংসতা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক আলোকিত বাংলাদেশ বলেন, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল নেই। প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে সংস্থাটি নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনেও রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকছেন ডিসিরা। তবে, তারা আগে কখনও নির্বাচন পরিচালনা করেননি। নির্বাচনি এলাকার ভোটগ্রহণ, গণনা এবং ফলাফল ঘোষণার জন্য সামগ্রিক দায়িত্ব পালনে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সৎ সাহস দেখাতে হবে। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সততায় নিঃসন্দেহে উত্তীর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ, র্যাব ও আনসারসহ সদস্য সব সংস্থাকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়াতে পারে। সেই গুজব ভোটারদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আগেও গুজব ছড়ানো হতো; কিন্তু এতটা ভয়াবহ হয়নি। গুজব মোকাবিলা করা এখন নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যেসব ডিসিরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন, তারা সেই পদে আর নেই। তাদের অনেকের পদোন্নতি হয়েছে কিংবা বেশকিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরও দেওয়া হয়েছে।
আবার অনেককে ওএসডি বা বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করেছে সরকার। ২০১৮ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ৪৫ জনকে চলতি বছরের শুরুতে ওএসডি করে সরকার। এছাড়া বিগত তিনটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলা প্রশাসকদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর হয়েছে, এমন ২২ জনকে তখন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। আর ২৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় ৪৩ জনকে ওএসডি করা হয়।
ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার প্রস্তাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কমিশন : ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও ইসির কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে। কমিশন এখনও এ ব্যাপারে- হ্যাঁ অথবা না কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি।
দেশের কোনো একটি জেলায় অনেক সময় একজন ডিসি ১০টির বেশি আসনের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। সেক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির পক্ষে একা এতো আসনে সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, কমিশন এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছে। তফসিলের দিন বিস্তারিত জানা যাবে।
