ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

‍"জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রয়োজন বেসরকারী উদ্যোগকে উৎসাহিত করা"

‍

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনই কমানো না গেলে খুব শিগগিরই বিশ্ববাসীকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে। মানুষ এবং প্রকৃতিকে ২০ বছর আগের তুলনায় আরও চরম আবহাওয়া মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাপমাত্রার পরিবর্তন বা ভারি বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটছে। পশুপাখি, কৃষি ও মানুষের মধ্যে ক্রমেই প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। জাতিসংঘ বলছে, এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে।

এটি সম্ভব হলে জনগণের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার পথ টেকসই হবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এ বছরটিই সম্ভবত এ শতাব্দীর সবচেয়ে শীতলতম একটি বছর হবে। কারণ, আমাদের গ্রহ ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে। আইপিসিসি বলছে, বিশ্বের সরকারগুলো জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করবে না। বিপরীতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে। এমনকি কয়েক দশকের গড় নির্গমন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিশ্বকে ২০৩০ সালের মধ্যে তার বার্ষিক কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন প্রায় ৫০ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নিট শূন্যে পৌঁছাতে হবে। এর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত কমাতে হবে।

বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন এবং জলাবদ্ধতা, মাটির লবণাক্ততা প্রভৃতির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। এ জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের নাগরিক এবং সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি জমি বন্যাপ্রবণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত; তাই জলবায়ু পরিবর্তন কৃষকদের খারাপভাবে প্রভাবিত করবে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, বাংলাদেশ ২১০০ সালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। প্রতিবেদনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তিন ফুট বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে। এতে দেশে ব্যাপক বন্যা হবে এবং ফসলহানি ঘটবে। এ কারণে দারিদ্র্য ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-১৩) জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। এসডিজি-১৩-এর টার্গেটগুলো ছিল-১. সব দেশে জলবায়ু সম্পর্কিত বিপদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন ক্ষমতা জোরদার করা, ২. জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যবস্থাগুলোকে জাতীয় নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনায় একীভূত করা, ৩. শিক্ষার উন্নতি, সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবিক ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, অভিযোজন, প্রভাব হ্রাস এবং প্রারম্ভিক সতর্কতা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ৪. অর্থবহ প্রশমন কর্ম এবং বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা মোকাবিলার জন্য ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার যৌথভাবে সংগ্রহ করার লক্ষ্যে UNFCCC-তে উন্নত দেশের পক্ষগুলোর গৃহীত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা এবং সবুজ জলবায়ুকে যত দ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা, ৫. স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় কার্যকর জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়াগুলো প্রচার করা এবং ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, নারী, যুবক এবং স্থানীয় ও প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোর ওপর ফোকাস করা এবং ৬. স্বীকার করা যে, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য প্রাথমিক আন্তর্জাতিক, আন্তঃসরকারি ফোরাম। সুতরাং, সেই লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হলে দেশগুলোকে আরও জলবায়ু-প্ররোচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে নিয়ে যাবে।

বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতে হলে প্রতিবছর বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ ২৬ গিগাটন কমাতে হবে; অর্থাৎ, প্রতিটি দেশকে তাদের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমাতে হবে। এটি ২০২২ সাল। আর মাত্র আট বছর বাকি। সুতরাং, এখনই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে বিশ্বকে আরও ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’ এবং ‘প্লানেটারি ইমার্জেন্সি’-পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সরকারের এমন নানা উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু সংক্রান্ত এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রয়োজন সরকারি- বেসরকারী যৌথ উদ্যোগ।

সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির (সিএসআর) অংশ হিসেবে বিএসআরএম, মেরিকো বাংলাদেশ, ইউনিলিভার, কোকাকোলা, তামাক কোম্পানির মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানান ধরনের প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে বৃক্ষাচ্ছাদিত জমির পরিমান বাড়াতে ‘বনায়ন’ এর মতো প্রকল্পগুলো কাজ করে যাচ্ছে। বনায়ন প্রকল্পের আওতায় গত ৪২ বছর ধরে দেশের ২২ টি জেলায় ১২ কোটিরও বেশি গাছ রোপন করে জলবায়ু প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বর্তমান প্রেক্ষিতে বনায়নের প্রভাব বেশ গভীর। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বনায়নের বিকল্প খুব কমই আছে। তাপমাত্রা মোকাবিলায় তো বটেই বনায়ন মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে। আর এই সামাজিক প্রভাবের গুরুত্ব সীমাহীন। বনায়নের কারণে স্থানীয় মানুষ সরাসরি ফল ও ওষুধি সেবা নিতে পারছে। এছাড়া গাছ বিক্রি করেও লাভবান হতে হচ্ছে। পরিণত বয়সে এসব গাছ কাঠ হিসেবে দারুণ কাজে দেয়। গবাদি পশুর খাবার সংগ্রহ একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বনায়নের কারণে সহজেই গবাদি পশুর খাদ্য সংস্থান সম্ভব হচ্ছে।

বনায়ন এর সামাজিক প্রভাবের গুরুত্ব কিছু তথ্য দেখলেই বোঝা যাবে। বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে জানা যায়, এর সুবিধাভোগীদের ৭৭ শতাংশই বৃক্ষরোপণের কারণে আয় করতে পেরেছে। সুবিধাভোগীদের ৪৯ শতাংশ জানিয়েছে তাঁদের আয় বেড়েছে। ৩৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন বনায়ন এর কারণে যে আয় হয়েছে তা দিয়ে তাঁরা অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পেরেছেন। কৃষি বা ছোট দোকানের পুঁজি বাড়াতে ওই টাকা যথেষ্ট কাজে এসেছে।

ঠিক পরিবেশ যেমন সচল রাখা যাচ্ছে তেমনি পরিকল্পিত বনায়ন এ সচল থাকছে মানুষের জীবিকাও। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি এসডিজি অর্জনে এমন প্রকল্পের বিকল্প নেই।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের সঙ্গে বেসরকারী এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগ যখন কাজ করছে তখনই দেশের নতুন প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর খসড়ায় সিএসআর বন্ধ করতে প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর ফলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন, সর্বপরি তাপমাত্রার বিরুপ প্রভাবের মতো জলবায়ু সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় গৃহীত নানান উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সর্বোপরি এসব সামাজিক উদ্যোগের ফলে যে লাখো উপরকারভোগী রয়েছেন তাদের জীবনমানে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এমতবস্থায় এসব উদ্যোগ বন্ধ করার মতো অবিবেচনাপ্রসূত পরিকল্পনা না করে বরং সরকারের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি সকল বেসরকারী উদ্যোগকে আরও উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন।

লেখক, প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আইপিসিসি,জলবায়ু পরিবর্তন
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত