ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন; আলোচনায় ৮ ও ১১ ফেব্রুয়ারি
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিফুল ইসলাম

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি চলছে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে। আগামী ডিসেম্বরের আগে ভোটের সব কাজ শেষ করে তফসিল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। এ লক্ষ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা, নতুন দলেন নিবন্ধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও কোনাকাটাসহ ভোটের সব কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চালিয়ে যাচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
ইসি ও সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, আগামী সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রাথমিকভাবে দুটি তারিখ সামনে রেখে কার্যক্রম চলছে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির ৮ অথবা ১১ তারিখে ভোটগ্রহণ হতে পারে। এ দুটি দিন নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। তবে ৮ ফেব্রুয়ারি রোববার ভোগ্রহণের সম্ভবনা বেশি। রোববারের আগে দুদিন সরকারি ছুটি থাকায় এ দিনটিকে ভোটের জন্য অগ্রাধিকার দিচ্ছে ইসি। এছাড়া গত তিনটি সংসদ নির্বাচন রোববারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর ৮ ফেব্রুয়ারি কোনো কারণে ভোট না হলে ভোটগ্রহণের জন্য ১১ ফেব্রুয়ারিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সংসদ ভোটের জন্য হাতে ৬০ দিনের মতো সময় রেখে আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে। তবে ভোটের চূড়ান্ত সিদ্ধন্ত নেবে সরকার ও ইসি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, সরকার যখন বলবে আমরা ভোট করব। আমাদের ডিস্মেবরের আগে সব প্রস্তুতি শেষ হবে। যে কোনো সময় ভোট করার জন্য প্রস্তুত আছে ইসি। ফেব্রুয়ারিতে ভোট করতে চাইলে কবে ভোট করা যেতে পারে এমন প্রশ্নে এ কমিশনার বলেন, আমাদের যখন ভোট করতে বলা হবে তখন নির্বাচন করব। তবে ফেব্রুয়ারিতে করতে গেলে প্রথমের দিকে করতে হবে। কারণ ১৭ তারিখের দিকে রমজান শুরু হবে। আমরা রোজার সময় ভোট করতে পারি না।
ইসি নির্বাচন পরিচলানা শাখা জানায়, ইসি একটি টাইম লাইন অনুয়ায়ী কাজ করছে। কোন মাসে কি কাজ শেষ করবে, এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে ইসি। কাজ শেষ হলে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যে কোন দিন ভোটের তফসিল দেবে। ইসির কর্মপরিকল্পনা থেকে যানা যায়, এবার সংসদ নির্বাচনে সম্ভব্যে ভোটার হবে ১২ কোটি ৮০ লাখ প্রায়। এছাড়া ভোটকেন্দ্র হবে প্রায় ৪৬ হাজার।
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতির বিষয়ে এক পর্যালোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনি পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার কথা জানান।
বৈঠকে নির্বাচনি প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে তিনি বলেন, কোনোক্রমেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠতে পারবে না। কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়, রাষ্ট্রের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। ভোটার যেন নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে ৬০ হাজার সেনাসদস্য মোতায়েন থাকবেন। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রেস সচিব বলেন, আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এই তিন মাসে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় জোরদারের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) বরাতে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, তারা (পুলিশ) মূলত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। তিনি আরও বলেন, সেনাসদস্যরা এর মধ্যেই গত ৫ আগস্ট থেকে মাঠে সক্রিয় আছেন এবং তাদের বিচারিক ক্ষমতাও রয়েছে।’ নির্বাচনের সময় ৬০ হাজার সেনাসদস্য মোতায়েন থাকবে বলেও জানান তিনি।
নির্বাচন ঘিরে গুজব ও ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ‘ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেন্টার’ গঠনের চিন্তাভাবনা করছে বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, এই সেন্টারটি খুব দ্রুত গুজব শনাক্ত ও প্রতিরোধ করবে এবং সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেবে। তিনি বলেন, এই কেন্দ্রটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইতিবাচক ও তাৎক্ষণিক কর্মকাণ্ড প্রচারে সাহায্য করবে, যেগুলো বর্তমানে প্রচার না পাওয়ায় অনেক সময় অজ্ঞাতই থেকে যায়।
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, আসন্ন নির্বাচনে যেসব জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ তা দ্রুত নির্ণয় করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময়ে যেসব জায়গায় সমস্যা হতে পারে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করে, সেসব জায়গা দ্রুত নির্ণয় করতে বলা হয়েছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বাড়তি কি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, সেসব বিষয় জানানোর জন্য তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সিচুয়েশন রিপোর্ট যেন কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠানো হয় এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা যেন বুঝতে পারেন ডাউন লেভেলের সিচুয়েশনটা কি এবং সেই অনুযায়ী যেন পদক্ষেপ নিতে পারেন। সেজন্য সিচুয়েশন রিপোর্ট কেন্দ্রে পাঠানোর জন্য সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উপ-প্রেস সচিব আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে প্রশাসনের রদবদল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আপনারা জানেন নির্বাচনের আগে প্রশাসনে একটা রদবদল হয়। সেই রদবদল কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সে বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা যায়, নির্বাচন কেন্দ্র করে আট লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে। ৫ লাখ ৭০ হাজার থাকবে আনসার এবং ১ লাখ ৪১ হাজার থাকবে পুলিশ বাহিনীর সদস্য।
এর আগে গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পরে দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ জুন ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকারপ্রধানের এই ঘোষণা বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই অসন্তুষ্টির কথা জানান। অবশ্য সরকার ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের জন্য উপদেষ্টাদের কেউ কেউ জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে অধ্যাপক ইউনূসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এপ্রিলকে উপযুক্ত মনে করেছিলেন। তবে ঈদুল আজহার এক সপ্তাহ পর লন্ডন সফরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি স্বস্তি প্রকাশ করে। ওই বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা আসে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে আগামী বছরের রমজান মাসের আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে।
