‘বিপজ্জনক’ খসড়া মানছে না জামায়াত-এনসিপি
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার টানা আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জনের পরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের মাটিতে আবার যেন স্বৈরশাসকের পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা নিশ্চিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর আইনি কাঠামোর (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) মাধ্যমে বাস্তবায়ন চেয়েছে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র তরুণদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে, গত সোমবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জুলাই সনদের যে খসড়া প্রকাশ করেছে সেটি অসম্পূর্ণ ও বিপজ্জনক বলে মনে করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বৃহস্পতিবারের মধ্যে জাতীয় সনদ চূড়ান্তের আশা দেখছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
জুলাই সনদের বিষয়ে গত ছয় জুন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে কয়টিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে’। ঐকমত্য কমিশন বলছে, সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সনদ বা সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি হবে, সেটি জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এরইমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠিয়েছে। খসড়া পর্যালোচনা করে জুলাই সনদের খসড়াকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করে জামায়াতে ইসলামী। খসড়া বাস্তবায়নে নির্বাচিত সরকারকে দুই বছরের সময় বেঁধে দেওয়া প্রস্তাবটি বিপজ্জনক ভাবছে দলটি। আর এনসিপি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়নি, অথচ খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, যা সঠিক হয়নি। এর তীব্র বিরোধিতা করে জুলাই সনদের খসড়া গ্রহণ করেনি দলটি।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীরা জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের জন্য ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ খসড়া প্রণয়নের দাবি করে আসছে। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার হাতে নিয়েছিল, আগামীর নির্বাচিত সরকারের সময়ও তার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে আসা যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হবে, দুই বছরের মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেখানে। খসড়াটি চূড়ান্ত হলে রাজনৈতিক দলের নেতা বা প্রতিনিধিদের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সদস্যদের সই করবেন।
জুলাই সনদের খসড়ায় যা আছে : জুলাই সনদের খসড়ায় একটি বাধ্যতামূলক রোডম্যাপ নির্ধারিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ এবং দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃত্ববাদ ও পদ্ধতিগত দুর্নীতির কবলে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কারের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। দেশের শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব-সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে- সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করার অঙ্গীকার রয়েছে পঞ্চম অনুচ্ছেদে। খসড়ার অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে এবং এর আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদানে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকব।
জুলাই সনদ ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী : গত মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের ২১ দিনের সংলাপের বিরতিতে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, সনদ অসম্পূর্ণ এবং কিছু অংশ বিপজ্জনক। তবে কমিশন বলছে, খসড়া একটি নমুনা মাত্র। তবে যদি সেটাই গ্রহণ করা হয়, তাহলে প্রস্তাবিত সনদ গ্রহণ করা যাবে না। তিনি বলেন, জামায়াত সনদের খসড়া করে কমিশনকে দেবে। সংলাপে যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি, সেগুলো বাস্তবায়নের আইনিভিত্তি থাকতে হবে। সনদ বাস্তবায়নের দুটি পথ থাকতে হবে- ১. অধ্যাদেশের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামো গঠন করে পরে নির্বাচিত সংসদে অনুমোদন। ২. গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া। সৈয়দ তাহের বলেন, যেকোনো একটি পদ্ধতিতে সনদের বৈধতা দিতে চাই। অন্যথায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ‘অনিশ্চয়তার দিকে’ চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদের খসড়ায় অনেক কিছুই অস্পষ্ট। সেখানে বিগত দিনে বিরোধীদলগুলোর আন্দোলন ও সংগ্রাম নিয়ে কিছু উল্লেখ নেই। সেগুলো থাকলে আরও ভালো হতো। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের জ্বলন্ত সব প্রমাণ থাকলেও এর বাস্তবায়নে দুই বছর সময় নেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
শিবির সভাপতির হুঁশিয়ারি : বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কোনো দলের চিন্তার অনুলিপি হলে তা ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। কাউকে ক্ষমতায় বসানো কিংবা ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য জুলাই হয়নি। জুলাই মানে বৈষম্য ও প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। জুলাই মানে আমূল পরিবর্তন’। ‘প্রয়োজনে আবার জুলাই ফিরে আসবে’ উল্লেখ করে শিবির সভাপতি বলেন, ‘জুলাই ঘোষণায় শহিদণ্ডগাজীদের রক্ত আর ত্যাগের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে হবে। শহিদের রক্ত এখনও আমাদের হাতে লেগে আছে। প্রয়োজনে আবার জুলাই ফিরে আসবে। কিন্তু কোনো দল বা গোষ্ঠীর তাঁবেদারি মেনে নেওয়া হবে না। মাইন্ড ইট’।
জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে এনসিপির অবস্থান : গতকাল মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১ দিনের সংলাপের বিরতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেছেন, আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে, সেগুলো নির্বাচনের আগে একটি আইনি কাঠামোর (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক) মাধ্যমে বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্যথায় জুলাই সনদ গ্রহণ করবে না এনসিপি। জাবেদ রাসিন বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা নির্বাচনের আগেই আইনগত ভিত্তি পেতে হবে। এর ভিত্তিতেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হতে হবে। জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে ময়মনসিংহ নগরীর টাউন হল চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমীন বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের আইনগত ভিত্তি থাকতে হবে। এ নিয়ে কোনো টালবাহানা চলবে না। আমরা বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাতে চেয়েছিলাম। জুলাই পদযাত্রার প্রথম ১৫ দিন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ঝামেলা ছাড়াই পদযাত্রা করেছি। কিন্তু এখন পদযাত্রায় এনসিপি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মঙ্গলবার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, জুলাই সনদের আগে সবার মানসিকতা সংস্কার করে আগে ‘মানসিক সনদে’ সব দলের স্বাক্ষর করানো দরকার। কারণ ইতিহাসকে গোপন বা বিকৃত করে জুলাই সনদ তৈরি হতে যাচ্ছে। এটাই কি নতুন বন্দোবস্ত? মনে হচ্ছে পূর্বপরিকল্পনার মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করা। এর কোনো প্রেক্ষাপট নেই। যারা এর রচয়িতা তারা নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পারছে না।’
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদের খসড়া পেয়েছি। তবে আরও পর্যবেক্ষণ করে আগামী ৩১ জুলাইয়ের পর এ নিয়ে মন্তব্য করতে চান তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদের খসড়ায় যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা সেগুলোর সঙ্গে একমত। তবে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তীব্র দ্বিমত পোষণ করছি। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের আগেই সনদের আইনিভিত্তি দিতে হবে। এর ভিত্তিতেই হবে জাতীয় নির্বাচন।
আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে, আন্তরিকতা থাকলে সেগুলো সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাস করা সম্ভব। তাহলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। এ নিয়ে যারাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, জনগণ তাদের মেনে নেবে না। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল- (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, জুলাই সনদকে নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে গণহত্যার বিচার করা জরুরি। কিন্তু খসড়ায় সে ধরনের কোনো নির্দেশনা নেই। এছাড়া বিগত দেড় দশকে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে নির্যাতিতদের বিষয়ে সেভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন জুলাই সনদের খসড়া বাস্তবায়ন নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছেন না। তিনি বলেন, এ ধরনের অঙ্গীকার আমরা অতীতেও দেখেছি, সেটার প্রেক্ষাপট হয়তো ভিন্ন ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের বাস্তবায়ন শেষমেশ হয়নি। এবার এটা দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবায়ন আদৌ হবে কি-না, তা সত্যিকার অর্থে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা পরবর্তী সরকারের ওপর নির্ভর করবে।
