জ্ঞা নভিত্তিক সমাজ গঠন তথা অর্থনীতি এই সময়ের একটি আলোচিত বিষয়। আভিধানিক অর্থে ‘জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি’ বা কে-ইকোনমির (নলেজ ইকোনমি) সংজ্ঞা মোটামুটি এরকম যে অর্থনীতিতে কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রমের চেয়ে মেধা বা জ্ঞানের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ, কৃষি ও শ্রমিকনির্ভর অর্থনীতি বা পি-ইকোনমি (প্রোডাকশন ইকোনমি) এর ঠিক উল্টোটা। এটা বলাবাহুল্য, একবিংশ শতাব্দীর এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে দাঁড়াতে চাইলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন তথা অর্থনীতির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের জন্য এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, জ্ঞানের ভিত্তিতে শুধু এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে একটি উৎপাদনশীল জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
২০১৪ সালের একেবারে শেষের দিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ‘জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ সূচকে এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থানবিষয়ক এক জরিপে দেখা যায় যে এশিয়ার জরিপকৃত ২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম (১.৪৯)। অর্থাৎ তালিকার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। আমাদের নিচে শুধু মিয়ানমার (০.৯৬)। এ ছাড়া আলাদাভাবে তিনটি সহসূচক যথা: উদ্ভাবন, শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোতে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ২৬, ২৫ ও ২৪তম। মূলত, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির জন্য অন্যতম যে চারটি মূল উপাদান অর্থাৎ শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রায় সব কটিতেই বাংলাদেশের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে।’ আর এই শিক্ষার মাধ্যম হচ্ছে বই। ভাল বই পড়া মানুষকে বিনয়ী ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিক্ষা দেয়। শেখায় সমাজব্যবস্থাকে প্রগাড় বিশ্লেষণ করতে এবং সমস্যা সমাধান করতে। বর্তমান পৃথিবীর ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা বুঝতে পেরেছে মানুষ যদি ভালো বই পড়ে, ভালো চিন্তা করে এবং অবহেলিত মানুষের পক্ষে কথা বলে তাহলে তাদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ব্যাহত হবে। তাই তারা মানুষকে যন্ত্রের মত ব্যস্ত রেখে ‘চিন্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে’ যদি আমাদেরকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে হয় তাহলে ভাল বই পড়ার গুরুত্ব অনেক।
ভালো বইয়ের কথা বলছি কারণ, মানুষ তার এই ছোট জীবনে সব বই পড়ে শেষ করতে পারবে না তাই তাকে একাডেমিক গবেষণা সম্পন্ন বই পড়া উচিত। আরেকটা প্রশ্ন মনে জাগতে পারে, কেন আমরা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলছি? বলছি এই কারণে যে- একজন সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক মনের মানুষই পারে সমাজকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে। যেই নেতৃত্ব সমাজে আন্তঃমানবিক সম্পর্ক তৈরি করবে এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। জানতে হবে পৃথিবী ও মহাবিশ্বকে। প্রশ্ন করা শিখতে হবে। আর এই জানা ও প্রশ্ন করা তৈরি হয় জীবননির্ভর বই পড়ার মাধ্যমে। বই পড়া আমাদের নিজস্ব সত্তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। পৃথিবীর উন্নতি সাধনে, আধুনিক জগতের প্রচার ও প্রসারে এবং মানুষের মরণব্যাধির প্রতিরোধে, জীবনদানের ব্যাপারে ওষুধপত্রাদি আবিষ্কারের বাহন হচ্ছে মহা মূল্যবান বই। পৃথিবীতে যাঁরা মরেও অমর হয়ে আছেন, সেসব মহামানব, ধর্মীয় নেতা, জ্ঞানী-গুণিজন, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-সাংবাদিক ও বৈজ্ঞানিক- সবাইকে এ বইয়ের মাধ্যমে আয়নাস্বরূপ প্রতীয়মান হয়। আর এ কথায় প্রতিধ্বনি শোনা যায় ঐতিহাসিক গীবনের ভাষায়- ‘বই হলো বিশ্বাসযোগ্য আয়নার মতো, যাতে আমাদের মনের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে, জ্ঞানী ও বীরদের মনের প্রতিবিম্বও এর থেকে বাদ পড়ে না।’ দার্শনিক ওমর খৈয়ামের ভাষায়- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে/প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে/কিন্তু একটি বই অনন্ত যৌবনা/যদি তা তেমন বই হয়’। ফ্রাৎস কাফকা বলেছেন, ‘আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাধা সমুদ্র সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই।’ শিক্ষা ও প্রকাশনা শিল্প পরস্পরের সহযোগী। মেধা-জ্ঞান ও চেতনা-মানবতাবোধ পরিপূরক। শিক্ষা জাতিগত উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আবার প্রকাশনা সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিকাশে সহায়ক। সত্যিকারভাবে বই হচ্ছে সভ্যতার সূতিকাগার, স্বপ্নের কারিগর, জ্ঞানের আঁধার ও মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমরা জানি, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বইমেলার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে তাদের সভ্যতা ও ঐতিহ্যের লালন ও পরিচর্চার অভিপ্রায়। আমাদের বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলাও আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধ সাহিত্যকে বিশ্ব ভাষাভাষীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে নিবেদিত। আমাদের প্রাণের অমর একুশে বইমেলা মননশীল মানবিক সমাজ বিনির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে এই শ্বাসরুদ্ধকর সময়কে আলোকিত করবে এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : কবি ও চিন্তক।