চির উন্নত মম শির

দেবব্রত নীল

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

(প্রবন্ধ)

বাংলা সাহিত্যের ধূমকেতু কাজী নজরুল ইসলামের অনবদ্য সৃষ্টি বাংলা ভাষাকে রূপৈশ্বর্যে বিকশিত করেছে। বাংলা ভাষার অভিধান মঞ্জুরিগুলোকে বিদ্রোহী শব্দ রাশির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি বাংলা ভাষাকেই অনন্য সৌন্দর্যে ভূষিত করেছেন। তাঁর অনন্য সাধারণ সৃষ্টি ভারত ও বাংলাদেশে এক অখণ্ড ও অবিভাজ্য মহিমায় বিধৃত হয়ে আছে। নজরুলের জীবন গতানুগতিক সাধারণ মানুষের মতো ছিল না। কবিতার মতোই তাঁর জীবন ছিল ঝঞ্জার মতো উদ্দাম, দুর্নিবার, দুর্বিনীত। বাধা-বন্ধনহীন হয়ে তিনি ছুটে বেড়াতেন বাংলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। বাঁধনহারা জীবনের সমস্ত পাওয়া না পাওয়ার বেদনাই তাঁর সৃষ্টিকে বৈচিত্র্যে ভরে তুলেছিল। তৈল মাখা ক্ষুদ্র তনু ও নিদ্রারসে ভরা কোমলকান্ত নিস্তেজ ম্লান জীবনে নূতন উদ্দীপনা ও উৎসাহের সঞ্চার করে তিনি মানুষকে মুক্তজীবনের ডাক শুনিয়েছিলেন।

নজরুল-প্রতিভার একটি বিশিষ্ট পরিচয় বহন করত তার চেহারা। যৌবনে নজরুলের গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চেহারায় ছিল আর্যের লক্ষণ। বড় বড় টানা কালো চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষè নাসিকা, উদ্দাম হাসি, বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহ। বিদ্রোহীর মতই উৎসাহে উজ্জ্বল চোখ। চোখ দুটি যেন পেয়ালা। হাঁটার সময় তার মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো নাচত। তার লেখা বিদ্রোহী ভাবাত্মক গান ও কবিতাগুলো যেন মূর্ত হয়ে উঠত বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহে।

নজরুল বিশ্বলয়ের বিরাট শিশু হয়ে খেলেছেন শব্দ নিয়ে। আরবি-ফারসি- উর্দু-হিন্দি- লোকজ-ততসমণ্ডসংস্কৃত-গুরুগম্ভীর-হালকাণ্ডদেশি-বিদেশি শব্দের বিপুল ভাণ্ডার হৃদয়ে ধারণ করে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন শব্দের জাগলার। শব্দের সমুদ্রে দেবতাদের মতো সমুদ্রমন্থন করে তুলে এনেছেন এক অমূল্য অমৃত ভাণ্ডার। নজরুলের কাব্য ও সংগীতে শব্দই হল প্রধান মূলধন। জীবনের সহস্র অনুভূতির অজস্র স্পর্শে তার কথা হয়ে উঠে নান্দনিক রূপকথা।

১৯২৯ সালে কবির অতি আদরের পুত্র বুলবুল মাত্র চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাকে হারানোর পর গানই হয়ে উঠে নজরুলের প্রধান শক্তি। তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯২৯ সালের ২৯ সালের ডিসেম্বর সঙ্গীতের প্রধান প্রশিক্ষক পদে উন্নীত হন। কাব্যজগতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি ডুবে যান সঙ্গীতের জগতে। শুরু করেন সঙ্গীতবিষয়ক ব্যাপক চর্চা ও সাধন। পাঠ করেন ফেলেন নবাব আলির লেখা সঙ্গীতবিষয়ক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ফারসি মারিফুন্নাগমাত’। নিজ দক্ষতায় তিনি হয়ে উঠেন সমকালীন সংগীত ভাবনার অন্যতম প্রধান পুরুষ। অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল বা রজনীকান্ত সেন ছিলেন সমকালীন সফল গীতিকার ও সুরস্রষ্টা। কিন্তু নজরুল শুধু সঙ্গীতের রূপকারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সঙ্গীত গবেষক ও আবিষ্কারক। রাগ-রাগিনির মেলবন্ধনে নজরুল গড়ে তুলেন বাংলা গানে বৈচিত্র্যের এক অনন্য ভাণ্ডার। তাঁর সঙ্গীতবিষয়ক জ্ঞান বাঙালির গানের দিগন্তকে বিস্তৃত করেছে। তাঁর ধ্রুপদি-রাগিনি আশ্রিত গান বাংলা গানকে করে তুলেছে সঙ্গীতের এক মহাসমুদ্র।

নজরুলের সঙ্গীত ভাবনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার সঙ্গীতে অসংখ্য রাগ-বাগিণী, তাল ও ছন্দের অন্তহীন বৈচিত্র্য। মাত্র এক দশকের মধ্যে তিনি প্রেমের গান ও স্বদেশ তথা আন্তর্জাতিক ভাবনা বিষয়ক গানের পাশাপাশি বিরহের গান, হাসির গান, মার্চিং সং বা সমর সঙ্গীত ইসলামি গান, শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, সজল, তুরি, কাওয়ালি, কীর্তন, ডুয়েট গান, প্যারোডি গান সহ অন্যান্য শত শত গান রচনা করে গিয়েছেন। নজরুল হিন্দি এবং উর্দুতেও অনেক সার্থকসংগীত রচনা করেন। ম্যাডান থিয়েটার সহ গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য নজরুল অসংখ্য গান রচনা করেন। তার পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়েছিল থালা ভরা পান আর অর্থের দিক দিয়ে শূন্যের পর মহাশূন্য। তাইতো অসুস্থ থাকার সময় ম্যাডান, গ্রামোফোন কারো টিকিও দেখা যায়নি।

১৯৩১ সালে সিনেমা জগতের সঙ্গে নজরুল যোগাযোগ শুরু করেন। সবাক যুগের প্রথম থেকেই তিনি বাংলা সিনেমায় কাজ করা শুরু করেন। তখন কলকাতায় ম্যাডান ফ্রামজি নামক এক ফরাসি ভদ্রলোক সিনেমার ব্যবসা শুরু করেন। তার কোম্পানির নাম ছিল পাইওনিয়ার কোম্পানি। এই কোম্পানিতেই কবি সুর ভান্ডারী পদে প্রথম নিযুক্ত হন। সুর ভান্ডারীর সুরসেনা হয়ে কবি নজরুল হয়ে উঠেন বাংলা গানের ধ্রুবতারা।

১৩৩০ সালের (১৯২৩) আশ্বিন মাসের ‘কল্লোলে’ নজরুলের সম্বন্ধে একটি পরিচয় লিপি প্রকাশিত হয়। এ সময় তার বয়স ছিল ২৪ বৎসর।

“কবি নজরুল ইসলা বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহ, মাথায় বড় বড় ঝাঁকড়া চল, গোঁফ আছে, বিদ্রোহীর মতই উৎসাহে উজ্জ্বল চোখ। চোখ দুটি যেন পেয়ালা, কখনো সে পেয়ালা খালি নেই, প্রাণের অরুণ রসে সুদই ভরপুর। গলাটি সারসের মতো পাতলা নয়, পুরুষের গলা যেমন হওয়া উচিত তেমনি সবল, বীর্য-ব্যঞ্জক। গলার স্বর ভারী, কিন্তু সেই মোটা গলার সুরে আছে যাদু। ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটার মতো তার গান আছড়ে পড়ত শ্রোতার বুকে। অনেক চিকন গলার গাইয়ের চেয়ে নজরুলের মোটা গলার গান লক্ষ গুণ ভালো লাগত। ... প্রবল হতে সে ভয় পেত না, নিজেকে মিঠে দেখাবার জন্যে সে কখনও চেষ্টা করত না। রবীন্দ্রনাথের পরে এমন শক্তিশালী কবি আর আসেনি বাংলা দেশে।’

প্রতিভা সোম ঢাকায় নজরুলের কাছে গান শিখেছিলেন। নজরুল তার বিখ্যাত গানের বই চোখের চাতক প্রতিভা সোমকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গে লেখা হয় ‘কল্যাণীয়া বীণা-কন্ঠী শ্রীমতী প্রতিভা সোম জয়যুক্তাসু’। পরে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে প্রতিভা সোমের বিবাহ হয়। স্মৃতিচারণে ঢাকায় দেখা নজরুল সম্পর্কে প্রতিভা সোম লিখেছেন,

‘থাকি ঢাকা শহরে, বয়স তখন ১৩। নজরুল ইসলামের বয়স তখন ৩০-৩২ অথবা তারও কিছু বেশি কি না আমি জানি না। যৌবন তার চোখে মুখে সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মতো বহমান ও বেগমান। সেই বয়সে তাকে যারা দেখেছেন শুধু তাদেরই বোঝানো যাবে কী দুকূলপ্লাবী আনন্দধারা দিয়ে গড়া তার চরিত্র। এই ব্যক্তিটি নানা কারণেই তাই নানা মানুষের কাছে এক কল্পনার নায়ক। বস্তুত এমনই একজন নায়ক কোন দেশে কোন কালেই অবিরল নয়। মস্ত বড়ো বড়ো টানা কালো চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, লাবণ্য সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা- সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। আর তার লাটিয়ে পড়া গেরুয়া চাদর।”

সাহিত্যসঙ্গীত ছাড়াও নজরুলের বিচরণ ছিল প্রায় সব ক্ষেত্রেই। রাজনীতি, সভাসমিতি, খেলার মাঠে, রঙ্গরসে ব্যঙ্গবিদ্রুপে সবখানেই তিনি ছিলেন সেরার সেরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর লাঞ্ছনা শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর কোলে জন্ম নেওয়া এক শ্রেষ্ঠ উপহার।

নজরুলের প্রকৃতি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু যা বলেছেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। ‘দেহের পাত্র ছাপিয়ে সব সময়েই উছলে পড়েছে তার প্রাণ, কাছাকাছি সকলকেই উজ্জীবিত করে মনের যত ময়লা, যত খেদ, যত গ্লানি সব ভাসিয়ে দিয়ে। সকল লোকই তার আপন, সব বাড়িই তার নিজের বাড়ি। শ্রীকৃষ্ণের মতো, তিনি যখন যার- তখন তার। জোর করে একবার ধরে আনতে পারলে নিশ্চিন্ত, আর ওঠবার নাম করবেন না- বড় বড় জরুরি এনগেজমেন্ট ভেসে যাবে।...হয়তো দু’দিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোথাও গান গাইতে গিয়ে সেখানেই একমাস কাটিয়ে এলেন; সাংসারিক দিক থেকে এ-চরিত্র আদর্শ নয়, কিন্তু এ-চরিত্রে রম্যতা আছে তাতে সন্দেহ কী। সেকালে বোহেমিয়ান চালচলন অনেকেই রপ্ত করেছিলেন- মনে মনে তাদের হিসেবের খাতায় ভুল ছিল না। জাত-বোহেমিয়ান এক নজরুল ইসলামকেই দেখেছি। অপরূপ তার দায়িত্বহীনতা।”

নজরুল-চরিত্রের সর্বজনীনতা তার সৃষ্টিকেও সর্বজনীন করে তুলেছিল। সাধারণ মানুষের মনের কথাগুলো সাহসের ফুল হয়ে পরাধীন দেশবাসীর নিকট আবির্ভূত হয়। সাহসের ফুল যখন শাসককে হুল ফুটাতে শুরু করল, তখন তার কলম কেঁড়ে নিয়ে বদ্ধ করা হলো কারাগারে। নজরুল বজ্রযোগী সন্ন্যাসীর মতো সত্যের সাধন করেছেন বলেই অমরত্বের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে নজরুলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) এর কলম বার বার কেঁদে ওঠে। জিজ্ঞাসার আকাঙ্ক্ষা তিনি ব্যক্ত করেন-

“কবি নজরুল ইসলাম

এক্ষুনি শুনিলাম।

তুমি নাকি মারা গেছ?।

এটা তো মিথ্যা খবর-

তুমি অবিনশ্বর,

তুমি বিদ্রোহী বীর,

মৃত্যুর কাছে তুমি কি নোয়াবে শির?”

বিদ্রোহী নজরুল জীবনে কারোর কাছে মাথা নত করেননি। মৃত্যুর কাছেও তিনি নতি স্বীকার করেননি। তিনি তাঁর জীবনের সমস্ত ধ্যান ও জ্ঞান দিয়ে যৌবনের বন্দনা করে গেছেন। নিপীড়িত, প্রবঞ্চিত ও পরাধীন মানুষের প্রতিনিধি হয়ে নজরুল শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে তার মানব জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যতদিন পৃথিবীতে শোষণ, অত্যাচার ও লাঞ্ছনা থাকবে, ততদিন নজরুল বেঁচে থাকবে শোষিত ও লাঞ্ছিত জনগণের মুক্তির সংগ্রামে অদম্য মনোবল, প্রেরণা ও শক্তি হয়ে।