প্রবন্ধ

ফররুখ আহমদ জীবন ও সাহিত্য

সুমন আমীন

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ফররুখ আহমদ। তিনি মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। কারণ তার কবিতা তৎকালীন বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা জোগায়। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহার ক্লিষ্টের করুণ পরিণতি, সমকালের সংকট, জরাগ্রস্ত বাস্তবতা, সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতা দেখে তিনি আঘাত পান। আর সকল অসঙ্গতিই তাকে সাহিত্য সাধনায় অনুপ্রেরণা জোগায়। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ট কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী। মাতা বেগম রওশন আখতার। গ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে কোলকাতায় এসে তালতলা মডেল এম.ই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তার পর কোলকাতার বিখ্যাত বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে ভর্তি হন। ঐ সময় কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রাথমিক জীবনে কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেন। ১৯৩৭ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৯ সালে কোলকাতার রিপন কলেজ হতে আইএ পাস করেন। কোলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে, প্রথমে দর্শন ও পরে ইংরেজীতে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু পড়াশোনা আর শেষ করতে পারেননি।

১৯৪৩ সালে আই.জি প্রিজন অফিসে চাকরির মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইয়ে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮সালে কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। ঢাকা বেতারে তিনি ‘ছোটদের খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন।

কবি ফররুখ আহমদ প্রথম যৌবনে ভারতবর্ষের বিখ্যাত কমরেড এম.এন রায়ের শিষ্য ছিলেন। কিন্তু জন্মসূত্রে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্যের অধিকারী কবি একসময় ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন। তার কবিতায় ইসলামী সমাজতন্ত্র মূর্ত হয়ে ওঠে।

কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার ‘মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালীন ভাষা বিতর্কের সময় থেকেই তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোরদার ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্টার পরপরই তিনি মাসিক সওগাত (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৪৭) সংখ্যায় পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন: ‘গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র্রভাষাকে পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রুপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীদের সঙ্গে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি’। বায়ান্নর রক্তাক্ত ঘটনার পর রেডিওতে কর্মরত শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম চৌধুরীদের নিয়ে তিনি ধমঘটে যোগদেন। তিনি তদানিন্তন পাকিস্তানি শাসকদের ব্যাঙ্গ করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে একটি নাটক লেখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকটি মঞ্চায়িত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী এতে অভিনয় করেন।

চল্লিশের দশকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে গণজাগরণমূলক কবিতা লেখে জনপ্রিয়তা পান কবি ফররুখ আহমদ। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী। ইসলামী আদর্শ ও আরব ইরানের ঐতিহ্য তার কবিতায় ব্যাঙময় হয়ে উঠে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় আরবী, ফারসী শব্দের যে স্বার্থক প্রয়োগ শুরু করেন, মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তা আরও বেগবান করেন। ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে ফররুখ আহমদ অসংখ্য কবিতা রচনা করেন। যার সংখ্যা প্রায় ১৯।

১৯৪৩ সালে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘আকাল’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তাতে কবি ফররুখ আহমদের বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতাটি স্থান পায়। দুর্ভিক্ষ নিয়ে অদ্যবধি বাংলা সাহিত্যে ‘লাশ’ এর মত কবিতা আর কেউ লিখতে পারেননি। দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যাথিত কবির উচ্চারণ-

‘যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর;

সন্ধ্যার জনতা জানি কোনোদিন রাখে না সে মৃতের খবর’।

রেনেসাঁর কবি, জাগরণের কবি, ঐতিহ্যের কবি, জাতিসত্তার কবি ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে মহান উচ্চতায় অধিষ্টিত। জাতীর আগামী স্বপ্নের জাল বুনতে পথ দেখিয়েছেন এই মহান কবি। তার শ্রেষ্ট সৃষ্টি ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্য গ্রন্থের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। এটি কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ। প্রকাশক ছিলেন কবি বেনজীর আহমদ। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। মুসলিম ঐতিহ্যের পুনর্জ্জীবন কামনা করে রোমান্টিকতার আবহে কবি জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বান করেছেন। অন্যরা যখন জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্যে এগিয়ে যাচ্ছে- কবি তখন পিছিয়ে পড়া তার নিজ জাতীকে জেগে ওঠার ডাক দেন। কবির আহ্বান-

‘কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা

নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।

দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা

তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?

সাত সাগরের মাঝি চেয়ে দেখো দুয়ারে

ডাকে জাহাজ

অচল ছবি সে, তসবীর যেন দাঁড়ায়ে

রয়েছে আজ।’

‘সাত সাগরের মাঝি’ বিস্ময়কর এক কবিতা গ্রন্থ। ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এটি। প্রকাশের এত বছর পরও এ গ্রন্থ সমানভাবে জাগ্রত ও প্রাণবন্ত। এ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম একটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতা হলো ‘পাঞ্জেরী’। মুসলিম জাতির পিছিয়ে পড়ার, অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের কত দেরী তা জানতে কবি উৎসুক।

‘রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?

এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?

সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?

তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;

অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরী।’

কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্র্যের সাথে জীবনযাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না। দারিদ্র্যতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগ বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করতেন। তার কবিতার মতই ছিল কবির দৈনিক জীবন।

‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া

তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।’

কবি ফররুখ আহমদের কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪), ‘সিরাজাম মুনিরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১), ‘মুহূর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘ধোলাই কাব্য’ (১৯৬৩), ‘হাতেম তায়ী’ (১৯৬৬), ‘নতুন লেখা’ (১৯৬৯), ‘কাফেলা’ (১৯৮০), ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’ (১৯৮১), ‘সিন্দাবাদ’ (১৯৮৩), ‘দিলরুবা’ (১৯৮৪)।

শিশু সাহিত্যেও তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ হলো- ‘পাখির বাসা’ (১৯৬৫), ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০), ‘চাঁদের আসর’ (১৯৭০), ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০), ‘ফুলের জলসা’ (১৯৮৫)।

বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ এর পরে অন্যতম সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদ রচিত ‘হাতেম তায়ী’। মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃত তিনি। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক। সনেট রচনায়ও সফল তিনি। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আর কোন কবি এত বেশি সফল সনেট রচনা করতে পারেননি। তার সনেট গ্রন্থের মধ্যে- ‘মুহূর্তের কবিতা’, ‘দিলরুবা’, ‘অনুস্বার’ প্রধান। গদ্য কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি ফররুখ আহমদ। তার গদ্য কবিতার সংকলন- ‘হাবেদা মরুর কাহিনী’ লিখে সফল তিনি। গীতিনাট্য ‘আনার কলি’ (১৯৬৬)।

কবি ফররুখ আহমদ কবি স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অন্যতম হলো- বাংলা একাডেমী (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (১৯৬৫), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), একুশে পদক (১৯৭৭-মরণোত্তর), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০-মরণোত্তর)।

কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তিনি তার কবিতায় সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা লিখে গেলেও তার জীবনে তাকে বহু দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। মূলত ইসলামী আদর্শ লালন করার কারণেই তাকে এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। ঢাকা বেতার থেকে তার চাকরি চলে যায়। তার এক ছেলে ডাক্তারি পড়ছিল, টাকার অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। চিকিৎসার অভাবে এক মেয়ে মারা যায়। তখন রমজান মাস ছিল। টাকার অভাবে ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে না খেয়েই রোজা রাখতেন তিনি। ২৭ রমজান ইন্তেকাল করেন কবি। তাকে কোথায় দাফন করা হবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক আসাফউদ্দৌলা রেজাসহ অনেকেই সরকারিভাবে কোনো জায়গা পাওয়া কি না, চেষ্টা করলেন। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো জায়গা পাওয়া যায়নি।

অবশেষে কবি বেনজীর আহমদ তার শাহজাহানপুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফন করার জায়গা দান করেন। কবি ফররুখ আহমদের করুণ পরিণতি দেখে আহমদ ছফা লেখেন- ‘আজকের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মতো একজনও শক্তিশালী স্রষ্টা নেই। এমন একজন স্রষ্টাকে অনাহারে রেখে তিলে তিলে মরতে বাধ্য করেছি আমরা। ভবিষ্যৎ বংশধর আমাদের ক্ষমা করবে না।’ বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কবি ফররুখ আহমদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। তিনি বেঁচে থাকবেন তার অমর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।