প্রবন্ধ

জীবনানন্দ দাশ : রহস্যময় নক্ষত্র

ফারজানা জিতু

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২২ অক্টোবর ছিল মহান কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, বরিশালের বকেরগঞ্জে। তার পিতা সরলনাথ দাশ শিক্ষক এবং ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আর মাতা কুসুমকুমারী দাশ নিজেও একজন কবি ছিলেন। এই সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ পরিবার তাঁকে কবিতার প্রতি অনন্য সংবেদনশীলতা ও প্রেমের বীজ দিয়েছিল।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেন; কিন্তু সাহিত্যের প্রতি প্রেম ছিলেন তাঁর প্রকৃত ঠিকানা।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতায় একটি ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন জীবনানন্দ, আট দিনের সংগ্রামের পর ২২ অক্টোবর পরপারে পাড়ি জমান। মৃত্যুর পরই তাঁর কবিতার প্রকৃত ব্যাপ্তি তথা সাংস্কৃতিক মর্যাদা বিশ্বময় স্বীকৃতি পায়।

বাংলার মাটির প্রতি গাঢ় ভালোবাসা : জীবনানন্দের কবিতায় বাংলা দেশের প্রাণ এবং প্রকৃতির সঙ্গে এক অনন্য দীর্ঘ স্নেহ ফুটে ওঠে। তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে বাংলার মাঠ, নদী, ধানখেত, তালগাছ, শালিক পাখি ও কাকের মতো ক্ষুদ্র জীবনের প্রতিটি দিক তাঁর হৃদয়ের প্রতিফলন।

তিনি লিখেছিলেন- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ এই লাইনটিতে তাঁর দেশপ্রেমের এক নিরিবিলি, হৃদয়ঙ্গম মমতার ছবি প্রদর্শিত হয়; যা রাজনীতির নয়, প্রকৃতি ও মানুষের মমতা থেকে উদ্ভাসিত। প্রেম ও একাকিত্বের কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রেম থাকে এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির পিঠিতে নয়; বরং মানুষের, জীবনের প্রেম, অস্তিত্বের প্রতি আকুল ভালোবাসার প্রকাশ।

তাঁর প্রখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম ও শান্তির প্রতীক। বনলতা সেন এক নারীরূপে নয়, নিঃসঙ্গ ও ক্লান্ত ভ্রমণকারীর আশ্রয়স্থল।

কবিতার ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি জীবনানন্দ দাশ বাংলা আধুনিক কবিতার জনক হিসেবে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও, তিনি একেবারে স্বতন্ত্র ভাষা ও ভাবনায় বাংলা কবিতার নতুন পরিসর সৃষ্টি করেছেন।

তাঁর কবিতায় সাধারণ জীবনের চিত্র যেমন একটি চড়ুই, ধানগাছ, সন্ধ্যার আলো ও মরা নদী দিয়ে জীবনের দর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর কবিতায় বেদনা, নিঃসঙ্গতা, মানবিক অন্তর্দৃষ্টি স্পষ্ট। দেশভাগ, যুদ্ধ, আধুনিক সভ্যতার ক্ষয়ক্ষতির ভাবনাও তাঁর রচনায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্মের চিরন্তন প্রাসঙ্গিকতা আজকের দ্রুতগতির আধুনিক জীবনে, যখন মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলো আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় বাংলার মাটির গন্ধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের অন্তর্মুখী ভালোবাসার মাঝ দিয়ে।

তিনি দেখিয়েছেন- নিঃসঙ্গতা যেমন জীবনকে সমৃদ্ধ করে, তেমনি ভালোবাসাও অমর হতে পারে মৃত্যুর অতীতেও। জীবনানন্দ দাশ শুধু একজন কবি ছিলেন না; তিনি বাংলা মাটির এক স্থির, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিচ্ছবি- নিঃসঙ্গ অথচ প্রেমে পরিপূর্ণ, নীরব অথচ গভীর।