প্রবন্ধ

হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রতিবাদ ও প্রেমের মিশ্রণ

প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রেম ও দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজের কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কবির কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) তার সৃজনশীল প্রতিভার উজ্জ্বল উদাহরণ। এটি তাকে বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রেম, ক্ষোভ, বিচ্ছেদ এবং স্বাধীনতার মতো ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে গভীরভাবে ধারণ করেছে। তার কবিতাগুলোতে বৈপ্লবিক চেতনা, অসাধারণ রূপক এবং সরল অথচ শক্তিশালী ভাষার সমন্বয় দেখা যায়।

তার লেখা কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ আজও সমানভাবে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে, বিশেষ করে ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ পঙক্তিটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ লেখায় আমরা কবি হেলাল হাফিজের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ সম্পর্কে কথা বলব।

প্রেমের কবিতা : হেলাল হাফিজের কবিতার মূল উপজীব্য বিষয়গুলোর একটি হলো- প্রেম, যা কবির জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। তার প্রেমের কবিতাগুলোতে একধরনের বিষণ্ণতা এবং অন্তর্দহন কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে ‘এখন যৌবন যার’ কবিতাটি প্রেমিকের এক নিঃসঙ্গ যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরে, যেখানে প্রেম আর যন্ত্রণার মাঝে এক আত্মিক টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়। প্রেমিকের নিঃসঙ্গতা এবং অপূর্ণতার অভিজ্ঞতা কবির ভাষায় প্রকাশ পায়।

রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা: এই কাব্যগ্রন্থে হেলাল হাফিজের রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার প্রতিফলনও স্পষ্ট। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ের চেতনাকে ধারণ করে। স্বাধীনতার জন্য যে আত্মত্যাগ এবং সংগ্রামের প্রয়োজন ছিল, তার প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। কবিতায় গণমানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও আত্মত্যাগের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিচ্ছেদ ও বেদনার প্রতিচ্ছবি : হেলাল হাফিজের কবিতায় বিচ্ছেদ এবং বেদনার দিকটিও প্রবলভাবে উপস্থিত। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ শিরোনামের কবিতাতেই এই বিষাদের গভীর প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তিনি যন্ত্রণাকে অনেকাংশে অস্তিত্বের অংশ হিসেবে দেখেছেন এবং সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছেন। বিচ্ছেদ শুধু ব্যক্তি জীবনের নয়, বরং সমষ্টিগত জীবনেরও প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে তার কবিতায়।

ভাষা ও শৈলী : হেলাল হাফিজের কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার ভাষার সরলতা এবং সংক্ষিপ্ততা। তার কবিতার ভাষা সহজ এবং সরাসরি হলেও তার মধ্যে রয়েছে গভীরতা ও অন্তর্দৃষ্টি। তার কবিতায় ব্যাকরণের কঠোর নিয়মের বাইরেও একটা নিজস্ব ছন্দ ও তালের ব্যবহার দেখা যায়, যা তার কবিতাকে অনন্য করে তোলে। তার ব্যবহার করা রূপক, চিত্রকল্প এবং উপমাগুলো সরাসরি পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যায়।

সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক : কবিতাগুলোর ভেতরে একজন সংবেদনশীল মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব এবং সমাজের প্রতি তার হতাশার প্রতিফলন দেখা যায়। হেলাল হাফিজের কবিতা শুধু ব্যক্তি বা প্রেমকে কেন্দ্র করে নয়, বরং বৃহত্তর সামাজিক সংকট এবং মানসিক প্রতিকূলতার চিত্রও তুলে ধরে। তার কবিতা যেন সেই যুগের মানুষের মনের একটি গভীর প্রতিফলন, যেখানে একদিকে আশা এবং অন্যদিকে হতাশা কাজ করে।

উল্লেখযোগ্য কবিতা : ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় কবিতা। এটি বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের সময়ের কবিতা, যেখানে তিনি সমাজের ভণ্ডামি এবং রাজনৈতিক অসততার বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন। কবিতাটি প্রকাশের পর থেকেই এটি বাঙালির প্রতিবাদী চেতনাকে জাগ্রত করে চলেছে। ‘তুমি চেয়েছিলে একটি নীলকাঁটায় মোড়ানো চিঠি’ কবিতাটি প্রেমের কবিতা হলেও এখানে গভীর বেদনা এবং পরাজয়ের সুর বাজে। প্রেমের ব্যর্থতা, আকাঙ্ক্ষা এবং অন্তর্নিহিত দুঃখগুলো এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে, যা পাঠককে সহজেই আবেগপ্রবণ করে তোলে।

কাব্যগ্রন্থের প্রভাব : ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ গ্রন্থটি প্রকাশের পর থেকেই হেলাল হাফিজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। তার এই গ্রন্থের কবিতাগুলো তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিশেষভাবে সাড়া ফেলে। প্রেম, দ্রোহ এবং হতাশার মিশ্রণে লেখা তার কবিতাগুলো ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় সংকটের বিপরীতে এক ধরনের বোধ জাগিয়ে তোলে।

হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সৃষ্টি। তার কবিতার গভীরতা, ভাষার সরলতা, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনা এই কাব্যগ্রন্থকে বিশেষ মাত্রায় উন্নীত করেছে। এই গ্রন্থে প্রেম, বিদ্রোহ, যন্ত্রণা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। তার কবিতার আবেদন আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। (সংগৃহীত)