নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করলেও অস্ত্র ছাড়বে না হামাস
অধ্যাপক শাব্বির আহমদ
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১০ অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে যে প্রশ্নটি বারবার ঘুরে-ফিরে আলোচনায় আসছে, সেটি হলো, গাজার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে? সর্বশেষ তথ্যমতে, ২৫ সেপ্টেম্বর সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের সিনিয়র নেতা গাজী হামাদ জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তবে অস্ত্র সমর্পণ করবে না। তিনি বলেন, আমরা গাজার শাসনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রস্তুত। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। একই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনি প্রশ্ন এবং ফিলিস্তিনি পরিস্থিতি থেকে হামাসকে বাদ দেওয়া অসম্ভব। কারণ, হামাস একটি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আরও বলেন, সংগঠনের সশস্ত্র শাখার একটি বৈধ এবং আইনি অস্ত্র রয়েছে; যা সর্বদা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০টি পয়েন্ট সম্বলিত নতুন একটি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা পেশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েল ও হামাস উভয়ে সেই পরিকল্পনায় সম্মতি জানানোর পর ১০ অক্টোবর থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হয় গাজায়। ট্রাম্পের ২০ পয়েন্টের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা অনুসারে যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে গাজায় আটক ইসরায়েলি জিম্মি এবং ইসরায়েলের কারগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেওয়া হবে। আর গাজায় ত্রাণের প্রবেশ বাধামুক্ত করা হবে এবং যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ের শেষে গাজায় একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক ও অসামরিক সরকার গঠন করা হবে। এ সরকারকেই ট্রাম্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছে ‘টেকনোক্র্যাট’ সরকার। এর আগে হামাসের নেতারা বলেছিলেন, গাজায় প্রস্তাবিত টেকনোক্র্যাট সরকারের অংশ হতে চায় গোষ্ঠীটি এবং সরকারের নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে থাকতে চায়। ২৫ অক্টোবর মিসরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সেই অবস্থান থেকে সরে এলো গোষ্ঠীটি। হামাসের সিনিয়র নেতা গাজী হামাদের বিবৃতির পরপরই ইসরায়েল সফরে থাকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী হামাসকে অবশ্যই নিরস্ত্র করা হবে। যদি হামাস অস্ত্র ত্যাগ না করে, তাহলে সেটি হবে চুক্তি লঙ্ঘন। আর সেই লঙ্ঘন মোকাবিলা করতেই হবে। হামাস ভবিষ্যতের গাজা শাসনে কোনোভাবেই থাকতে পারবে না। এমতাবস্থায় গাজায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যত দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধের অভিঘাতে গাজার প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। হামাস হয়তো সংখ্যায় কমে গেছে, কিন্তু তাদের মনোবল এখনও অটুট। বর্তমানে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা এখন প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের পক্ষে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে এরইমধ্যে দুশো’র বেশি লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে হামাস। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা ইসরায়েলি দখলদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, ত্রাণ কাফেলা লুট করেছেন এবং সেই মালামাল কালোবাজারে বিক্রি করেছেন। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পাশ কাটিয়ে গাজায় ক্ষুদ্র গোত্রগুলোর শক্তি বাড়ানোর কৌশল নিয়েছিল। হামাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া গোষ্ঠীগুলোও সময় নিয়ে নিজেদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল। হামাস বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ‘ডগমুশ’ ও ‘শাবাব’ অন্যতম। হামাস যখন কঠোর হাতে গাজা শাসন করত, এ গোত্রগুলো তখন তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলত। বিনিময়ে গাজার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন-ইসরায়েলি পরিকল্পনা সত্ত্বেও হামাসকে গাজার মাটি ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা অত সহজ নয়। গাজায় হামাসের শিকড় অনেক গভীরে। হামাস কেবল একটি সরকার বা সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়; এটি একটি আদর্শ, একটি সামাজিক আন্দোলন এবং পৃষ্ঠপোষকতার নেটওয়ার্ক। গাজায় ক্ষমতা হারানো মানে হামাসের অস্তিত্ব নাই হয়ে যাওয়া। সংঘাতের হেরে যাওয়া পক্ষের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা যুদ্ধের মতোই প্রাচীন ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে লুকিয়ে থাকা জাপানি সেনা থেকে শুরু করে ইরাক দখলের পর সাদ্দাম হোসেনের অনুগত যোদ্ধা, আফগানিস্তানের তালেবান- সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে, পরাজিত শক্তি সচরাচর পরাজয় মেনে নেয় না। পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা প্রায়ই ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদকে (পিআইজে) উপেক্ষা করেন। এ সংগঠন হামাসের কনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে। যুদ্ধের আগে পিআইজির সশস্ত্র যোদ্ধার সংখ্যা কয়েক হাজার বলে ধরা হতো। যুদ্ধে হামাসের কয়েক হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন। ফলে যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতায় পিআইজের নেতৃত্ব নিজেদের শীর্ষ অবস্থানে থাকার দাবি করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ভাবতে পারেন। এছাড়া পিইজের এমন কিছু আছে, যেটা গোত্রভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নেই। সেটি হলো রাজনৈতিক বৈধতা অথবা অন্তত সশস্ত্র আন্দোলনের সমতুল্য স্বীকৃতি। এ সংগঠনের ফিলিস্তিন অঞ্চলের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হামাসের মতোই তাদেরও আদর্শগত ভিত্তি আছে। আছে সুসংহত নেতৃত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন। পিআইজে ইসরায়েলি অভিযানের মুখেও দশকের পর দশক ধরে টিকে আছে। এ ছাড়া পশ্চিম তীরেও পিইজের শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। হামাস যদি গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে না পারে, তাহলে পিআইজেকে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে দেখা যেতে পারে। ইসরায়েলের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইরান-সমর্থিত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর জায়গায় আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন। ১৯৮০-এর দশকে মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে বেরিয়ে হামাসের জন্ম হয়েছিল। হামাসকে ইসরায়েল কৌশলগত উৎসাহ দিয়েছিল। এটাকে ইসরায়েল ইয়াসির আরাফাতের সেক্যুলার দল পিএলওর বিরুদ্ধে ভারসাম্য হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু এরপর কী ঘটেছে, সেটি সবারই জানা। মার্কিন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গাজার জন্য আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগ দিতে ইন্দোনেশিয়াসহ এরইমধ্যে অনেক দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, অনেক দেশ আইএসএফ-এ অংশ নিতে চেয়েছে। তবে তিনি বাহিনী গঠনের সময় অবশ্যই ইসরায়েলের পছন্দের ভিত্তিতে বা ইসরায়েলকে নিয়ে আপত্তি নেই, এমন দেশগুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে মর্মে বিবৃতি দিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। বিশ্লেষকদের মতে, তুরস্ককে ইঙ্গিত করে বক্তব্যটি দিয়েছেন রুবিও। আঙ্কারার যোগদান দিয়ে তেল আবিবের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। আইএসএফ-এর দায়িত্ব এখনও অস্পষ্ট। কারণ, অনেক দেশ আশঙ্কা করছে, হামাসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সমঝোতা না হলে আইএসএফকে হামাস বা ইসলামি জিহাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াতে হতে পারে। রুবিও বলেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। তবে সামনের দিনগুলোতে অনেক ‘উত্থান-পতন ও জটিলতা’ আসবে বলেও সতর্ক করেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার আপাতত কোনো বিকল্প নেই দাবি করে রুবিও বলেন, এটাই একমাত্র পরিকল্পনা এবং আমরা বিশ্বাস করি, এটি সফল হতে পারে। তার মতে, এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় এবং গাজায় এমন কোনো শক্তি টিকে না থাকে, যা ইসরায়েল বা অন্য কারো জন্য হুমকি। গাজার ভবিষ্যত খুবই অন্ধকারাচ্ছন্ন। গাজার আকাশে এখনও ঘুরে ঘুরে শকুন উড়ছে। সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরেই উড়তে থাকবে। হামাস সহজে তাদের কর্তৃত্ব ছাড়বে না, গোত্রগুলো সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে, আর পিআইজে তাদের মুহূর্ত আসার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। এদিকে সাধারণ গাজাবাসীকেই মূল্য চুকিয়ে যেতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক
