বিশ্বখ্যাত প্রভাবশালী মুসলিম শাসক

শাসকশ্রেণি বরাবরই ইতিহাসের প্রধানতম চরিত্র। এদের কেউ মহানায়ক, কেউ আবার খলনায়ক। কাউকে জনতা চেনে জালেম হিসেবে, কাউকে বরণ করে নেয় পরম যত্নে। মুসলিম বিশ্বে এমন কয়েকজন শাসক গত হয়েছেন, যারা নানা কারণে নানা অভিধায় পৃথিবীর ইতিহাসে আলোচিত। সাম্প্রতিক সময়ে গত হওয়া এমন কয়েকজন মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের কথা তুলে ধরছেন- হাবীবুল্লাহ সিরাজ

প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ড. মুহাম্মদ মুরসি (মিসর) : ড. মুহাম্মদ মুরসি মিসরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এবং সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম আলোচিত প্রভাবশালী ইসলামপন্থী নেতা। ২০ আগস্ট ১৯৫১ সালে মিসরের নীল ডেল্টা অঞ্চলের শারকিয়া প্রদেশের আল-আদওয়া গ্রামে তার জন্ম। একটি সাধারণ কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা মুরসি ছোটবেলা থেকেই অধ্যবসায়ী, চৌকান্ন, তীক্ষè ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পরে মিসরে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। মুরসি দীর্ঘদিন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। হুসনে মোবারক সরকারের সময়ে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন। ২০১১ সালের আরব-বসন্ত পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারায় তিনি ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। ২০১২ সালে মিসরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সংবিধান সংস্কার, বেসামরিক শাসন জোরদার এবং ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে গণতন্ত্রের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি ফিলিস্তিন প্রশ্নে দৃঢ় অবস্থান নেন এবং আঞ্চলিক স্বাধীন নীতির চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো বৈশ্বিক পরাশক্তির তোয়াক্কা করতেন না। তবে প্রশাসনের ভেতরে বিরোধীপক্ষ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, বিশেষে করে, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে তার শাসনকাল দীর্ঘ হয়নি। মাত্র এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিসরীয় সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর দীর্ঘ কারাবন্দিত্ব, বিচার ও অচিকিৎসার মধ্য দিয়ে ১৭ জুন ২০১৯ সালে আদালত কক্ষেই তার মৃত্যু হয়। মুহাম্মদ মুরসি আজও মুসলিম বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে আছেন একজন নির্বাচিত ইসলামপন্থী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে; যিনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দীর্ঘ সময়ের স্বৈরতন্ত্র ভেঙে গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছিলেন।

দাতুক সেরি আনোয়ার ইবরাহিম (মালয়েশিয়া) : দাতুক সেরি আনোয়ার ইবরাহিম সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামপন্থী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিক। ১০ আগস্ট ১৯৪৭ সালে মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যের বুকিত মার্তাজামে তার জন্ম। মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা আনোয়ার শৈশব থেকেই নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও সামাজিক ন্যায়নীতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি মালয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মালয় স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ইসলামি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীতে ABIM (Angkatan Belia Islam Malaysia)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিতি লাভ করেন। এ সময় তিনি ইসলামি মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায় ও দুর্নীতিবিরোধী রাজনীতির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন।

১৯৮২ সালে আনোয়ার ইবরাহিম ক্ষমতাসীন UMNO দলে যোগ দেন এবং দ্রুত রাজনীতির শীর্ষস্তরে উঠে আসেন। তিনি শিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত উপপ্রধানমন্ত্রী (১৯৯৩-১৯৯৮) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সংস্কার ও শিক্ষা উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে পদচ্যুত হন এবং বিতর্কিত মামলায় কারাবরণ করেন। বহু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্বনেতারা এ বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে আখ্যা দেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, কারাবন্দিত্ব ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি মালয়েশিয়ার মান্যবর নেতা, সাম্যবাদ ও গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ দুই দশকের লড়াইয়ের পর আনোয়ার ইবরাহিম ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দুর্নীতিবিরোধী শাসন, বহুত্ববাদী সমাজ, ইসলামি নৈতিকতা ও গণতন্ত্রের সমন্বয়কে তার রাজনৈতিক দর্শনের মূলভিত্তি করেছেন।

রশিদ আল-গান্নুশি (তিউনিসিয়া) : রশিদ আল-গান্নুশি আধুনিক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইসলামপন্থী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যিনি ইসলামি মূল্যবোধ ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ের ধারণাকে বাস্তব রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। ২২ জুন ১৯৪১ সালে তিউনিসিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের গাবেস প্রদেশের এল-হাম্মা গ্রামে তার জন্ম। একটি ধর্মপ্রাণ ও সাধারণ পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। প্রাথমিক শিক্ষা তিউনিসিয়ায় সম্পন্ন করার পর তিনি জেইতুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষা অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য মিসরের কায়রো ও পরে সিরিয়ার দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। আরবি ও পাশ্চাত্য দর্শনের সমন্বিত জ্ঞান তার চিন্তাধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ১৯৭০-এর দশকে গান্নুশি তিউনিসিয়ায় ইসলামি পুনর্জাগরণমূলক রাজনীতিতে যুক্ত হন। পরে আন-নাহদা আন্দোলন গঠনে প্রধান দায়িত্বশীল নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্ট হাবিব বুরগিবা ও জাইনুল আবেদিন বিন আলির স্বৈরশাসনের সময় তিনি কারাবরণ ও দীর্ঘ প্রবাস জীবন (প্রায় ২০ বছর) কাটাতে বাধ্য হন। ২০১১ সালের আরব-বসন্তের পর স্বৈরশাসনের পতন হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আন-নাহদা তিউনিসিয়ার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। এরপর তিনি ২০১৯ সালে তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি জাতীয় সংলাপ, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং ইসলামপন্থীদের গণতান্ত্রিক ধারায় সম্পৃক্ত করার পক্ষে কাজ করেন। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তর, বহুদলীয় ব্যবস্থা ও নাগরিক স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। তিনি আজও ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক প্রভাবশালী নাম। যদিও বিশ্বের অনেক ইসলামপন্থী নেতারা তার ইসলাম ও গণতন্ত্রের সমান্তরাল যাত্রাকে ভালোভাবে নেয়নি।

কিং ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ (সৌদি আরব) : কিং ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আলে সৌদ আধুনিক সৌদি আরবের ইতিহাসে এক দূরদর্শী শাসক ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হিসেবে স্মরণীয়। ১৪ এপ্রিল ১৯০৬ সালে রাজধানী রিয়াদে তার জন্ম। তিনি ছিলেন সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কিং আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের তৃতীয় পুত্র। ধর্মপরায়ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফয়সাল ছোটবেলা থেকেই কোরআন-হাদিস ও আরবি শিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। শৈশবেই তিনি কূটনৈতিক দায়িত্বে অভিষিক্ত হন। কিশোর বয়সে ইউরোপ সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। আনুষ্ঠানিক পাশ্চাত্য শিক্ষা সীমিত হলেও বাস্তব প্রশাসন, কূটনীতি ও ইসলামি জ্ঞানে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। কিং ফয়সাল দীর্ঘদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬৪ সালে সৌদি আরবের বাদশা হন। তার শাসনামলে তিনি একদিকে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলেন, অন্যদিকে ইসলামি নীতিমালাকে রাষ্ট্রপরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রাখেন। শিক্ষা সম্প্রসারণ, প্রশাসনিক সংস্কার, নারীদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার শাসনামলে সৌদি আরব প্রথমবারের মতো আধুনিক পরিকল্পিত রাষ্ট্রে রূপ নিতে শুরু করে। তিনি বিচারব্যবস্থায় শরিয়ার প্রাধান্য বজায় রেখে প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনেন এবং রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল অত্যন্ত সংযমী ও সাধারণ; যা জনগণের কাছে তাকে একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। অন্যদিকে তার সময় ও তার আগের সময়কার সরকারে থাকা ব্যক্তিবর্গরা ছিলেন বিলাসী আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত; যা দেশের জনগণের কাছে তাদেরকে অপ্রিয় করে তোলে। কিং ফয়সাল ছিলেন সম্পূর্ণ তাদের বিপরীত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিং ফয়সাল বিশেষভাবে পরিচিত ইসলামি ঐক্য ও উম্মাহ চেতনার প্রবক্তা হিসেবে। ১৯৬৯ সালে রাবাত সম্মেলনের মাধ্যমে OIC (Organization of Islamic Cooperation) প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে তেল অবরোধ আরোপ করে তিনি মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করেন; যা তাকে বিশ্ব রাজনীতিতে অনন্য মর্যাদা দেয়। ২৫ মার্চ ১৯৭৫ সালে তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।

মাহমুদ আহমদিনেজাদ (ইরান) : ইসলামি দুনিয়ার প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেন ইরানের মাহমুদ আহমদিনেজাদ। তিনি সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে এক সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ইসলামপন্থী রাষ্ট্রনায়ক; যিনি নিজেকে ইরানি ইসলামি বিপ্লবের আদর্শিক উত্তরাধিকারী দাবি করে সে অনুযায়ী রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ছিলেন বদ্ধপরিকর। ২৮ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে ইরানের সেমনান প্রদেশের আরাদান শহরে তার জন্ম। একটি সাধারণ, মধ্যবিত্ত ও ধর্মপরায়ণ পরিবারে তার শৈশব কেটেছে। পরে পরিবারসহ তিনি তেহরানে বসবাস শুরু করেন, যেখানে ইসলামি বিপ্লবপূর্ব ও বিপ্লব-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবেশ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তখন থেকেই মূলত রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ইরান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাফিক ও পরিবহন প্রকৌশলে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবনে তিনি ইসলামি বিপ্লবপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে কাজ করার পথ বেছে নেন। তার রাজনৈতিক উত্থান ঘটে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে। তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পর ২০০৩ সালে তেহরানের মেয়র নিযুক্ত হন। মেয়র হিসেবে তিনি সরল জীবনযাপন, ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারে জোর এবং অভিজাত শ্রেণির বিরোধিতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ জনপ্রিয়তার ভিত্তিতেই তিনি ২০০৫ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে আহমদিনেজাদ নিজেকে দরিদ্র ও বঞ্চিত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি সামাজিক ভর্তুকি বৃদ্ধি, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং বিপ্লবী ইসলামি মূল্যবোধ জোরদারের উদ্যোগ নেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাশক্তির বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় কথা বলেন। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অধিকার রক্ষায় আপসহীন অবস্থান নেন। একই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে মুসলিম বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। তবে তার শাসনামল অর্থনৈতিক দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, মুদ্রাস্ফীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বিতর্কিত হয়ে ওঠে। ২০১৩ সালে সাংবিধানিক মেয়াদ শেষে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেন।

ওমর আল-বশির (সুদান) : ওমর হাসান আহমদ আল-বশির ছিলেন একজন বিতর্কিত সমালোচিত শাসক। তিনি সুদানের দীর্ঘতম শাসক এবং সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের অন্যতম ইসলামপন্থী রাষ্ট্রনায়ক। ১ জানুয়ারি ১৯৪৪ সালে সুদানের নাইল নদী তীরবর্তী হোশ বানাগা গ্রামে তার জন্ম। একটি সাধারণ গ্রামীণ পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকেই তিনি শৃঙ্খলাপরায়ণ ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি সুদান মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মিসরের কায়রো মিলিটারি কলেজে প্রশিক্ষণ নেন। সেনাবাহিনীতে কর্মজীবনের সময় তিনি আরব-ইসরাইল যুদ্ধসহ বিভিন্ন সামরিক অভিযানে অংশ নেন, যা তাকে বাস্তব যুদ্ধ ও রাষ্ট্রক্ষমতার অভিজ্ঞতা দেয়। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন ওমর আল-বশির একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের ক্ষমতা দখল করেন। এ অভ্যুত্থানের পেছনে ইসলামপন্থি চিন্তাবিদ হাসান আত-তুরাবির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি নিজেকে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবক্তা হিসেবে উপস্থাপন করেন। সুদানে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন, ইসলামি নীতি ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা চালু করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ১৯৮৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর সুদানের ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসনামলে অবকাঠামো উন্নয়ন, তেল সম্পদের ব্যবহার এবং কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণ ঘটলেও গৃহযুদ্ধ, দারফুর সংকট, দারিদ্র সমস্যা এবং একপেশীয় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে গভীর সংকটে ফেলে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ আনে। যা তাকে বিশ্ব রাজনীতিতে চরমভাবে বিতর্কিত করে তোলে। তাকে বিশ্ব দরবারে বিতর্কিত করে তোলে মূলত পশ্চিমা ও আমরিকান মিডিয়াশক্তি। কারণ, তিনি বারবার তাদের পেশিশক্তি ও অন্যায় নীতির কাছে আপস করেননি। এ কারণে বারবার সুদানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করত যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘ অর্থনৈতিক সংকট ও গণআন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত ও গ্রেপ্তার হন। একদিকে ইসলামপন্থি দীর্ঘস্থায়ী শাসনের প্রতীক হিসেবে, অন্যদিকে কঠোর শাসন, পশ্চিমার একপেশী নীতিবিরুদ্ধ প্রবল সমালোচনার কারণে গভীরভাবে বিতর্কিত এক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ওমর আল-বশির স্মরণীয়।

মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি (লিবিয়া) : মুয়াম্মার মুহাম্মদ আবু মিনইয়ার আল-গাদ্দাফি ছিলেন লিবিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা শাসক এবং আরব-মুসলিম বিশ্বের অন্যতম আলোচিত সফল রাষ্ট্রনায়ক। ৭ জুন ১৯৪২ সালে লিবিয়ার সির্ত অঞ্চলের কাসর আবু হাদি এলাকার একটি দরিদ্র গ্রাম্য পরিবারে তার জন্ম। মরুপ্রধান পরিবেশে বেড়ে ওঠা গাদ্দাফির শৈশব তাকে আত্মনির্ভরতা, কঠোরতা ও নিজস্ব জাতিসত্তার প্রতি গভীর অনুরাগী করে তোলে। সে সময় তিনি নিজের জাতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার শপথ করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বেনগাজি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। পরে লিবিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। মিশরের জামাল আবদুল নাসিরের আরব জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি সমাজচিন্তা তার রাজনৈতিক মানসিকতা গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৭ বছর বয়সে গাদ্দাফি এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজা ইদরিসের শাসনের অবসান ঘটিয়ে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রাষ্ট্রপতি’ পদ গ্রহণ না করে নিজেকে ‘বিপ্লবের নেতা’ হিসেবে পরিচয় দেন। তার শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ইসলামি মূল্যবোধ, আরব সমাজতন্ত্র ও সম্যক গণতন্ত্রের ধারণা; যা তিনি তার বিখ্যাত ‘গ্রিন বুক’-এ তুলে ধরেন। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে লিবিয়ার তেল সম্পদ জাতীয়করণ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেন। ফলে লিবিয়ার জীবনমান এক সময় আফ্রিকার শীর্ষে পৌঁছায়। একই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিন, আফ্রিকা ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন আন্দোলনে সমর্থন দেন এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখেন। তবে তার শাসনামল একনায়কতন্ত্র, মতপ্রকাশ দমন এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে আমেরিকাণ্ডইউরোপের কাছে বেশ সমালোচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি কখনও তাদের পরোয়া করতেন না। ২০১১ সালের আরব-বসন্তের প্রভাবে ন্যাটো সমর্থিত বিদ্রোহের মুখে তার শাসনের পতন ঘটে। ২০ অক্টোবর ২০১১ সালে সির্তে তিনি নিহত হন। একদিকে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী ও মুসলিমণ্ডআফ্রিকান ঐক্যের কণ্ঠস্বর হিসেবে, অন্যদিকে দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতীক হিসেবে তিনি স্মরণীয়। তিনি যতদিন লিবিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন, ততদিন লিবিয়া ছিল আরব-আফ্রিকা দুনিয়ার অন্যতম মুসলিম প্রভাবক রাষ্ট্র।

মোল্লা মুহাম্মদ ওমর (আফগানিস্তান) : মোল্লা মুহাম্মদ ওমর শুধু আফগানিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ইসলামপন্থি নেতা নন, সারাবিশ্বের বেসামরিক ইসলামপন্থীদের প্রিয় নেতা। কারণ, তিনি সাম্রাজ্যবাদী কোনো শক্তিকে ছাড় দিয়ে নীতি বাক্য আওড়াতেন না। ১৯৫৯ বা ১৯৬০ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের খাকরেজ এলাকায় একটি দরিদ্র পশতুন পরিবারে তার জন্ম। শৈশবেই পিতৃহারা হওয়ায় তার জীবন কেটেছে দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। স্থানীয় মাদ্রাসায় কোরআন ও ইসলামি জ্ঞানার্জন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদের সময় (১৯৮০-এর দশক) তিনি একজন প্রধানতম মুজাহিদ হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন এবং একটি চোখ হারান বলে ধারণা করা হয়। যুদ্ধোত্তর আফগানিস্তানে মুজাহিদ গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক সংঘর্ষ, লুটপাট ও নৈতিক অবক্ষয়ে তিনি গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হন। এ প্রেক্ষাপটেই ১৯৯৪ সালে কান্দাহারে তার নেতৃত্বে তালেবান আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যার লক্ষ্য ছিল শরিয়াভিত্তিক শাসন, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন। তালেবান দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে। মোল্লা মুহাম্মদ ওমর নিজেকে ‘আমিরুল মোমিনিন’ ঘোষণা করেন এবং ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগ করা হয়; যা একদিকে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনে, অন্যদিকে নারী শিক্ষা, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমালোচনার জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে। ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে অবৈধ জাতিসংঘের বিনা অনুমতিতে আক্রমণে তালেবান সরকারের পতন ঘটে। এরপর মোল্লা ওমর আত্মগোপনে চলে যান। তিনি প্রকাশ্যে খুব কমই উপস্থিত হয়েছেন এবং তার জীবন দীর্ঘদিন রহস্যেঘেরা ছিল। পরে জানা যায়, তিনি ২০১৩ সালে আফগানিস্তানেই অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন, যদিও তার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করা হয় ২০১৫ সালে। একদিকে একজন প্রভাবশালী ইসলামপন্থি শাসক ও প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা হিসেবে, অন্যদিকে বিশ্বমোড়লদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রামের কারণে তিনি পশ্চিমাদের কাছে সন্ত্রাসী আর সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে হিরো হিসেবে আজও আলোচিত।

লেখক : গবেষক, আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ও শিক্ষক