সারা বছরই ঝুঁকিপূর্ণ রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মো. হান্নান, রাঙামাটি

রাঙামাটির পর্যটন কমপ্লেক্সে অবস্থিত ‘ঝুলন্ত সেতু’ একসময় ছিল একটি স্বপ্নের গন্তব্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে স্মৃতির ছবি তুলে নেওয়ার এক জনপ্রিয় স্থান। কিন্তু এখন এটি হয়ে উঠেছে আতঙ্ক আর অবহেলার প্রতীক। সাধারণত প্রতিবছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। তখন রাঙামাটির অন্যতম আকর্ষণ ‘ঝুলন্ত সেতুটি’ প্রায় তিন থেকে চার মাস পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে থাকে। ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ কাঠের এই সেতুটি পানির মধ্যে ডুবে থেকে কাঠামোগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্ষা শেষে যখন পানি কমে, তখন সেতুটি ভেসে ওঠে ঠিকই কিন্তু থেকে যায় অসংখ্য ফাটল, কাঁপুনির অনুভব, আলগা নাট-বল্টু ও কাঠের পাটাতনে গর্ত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবছর বর্ষা এলেই সেতুটি পানির নিচে তলিয়ে যায়, অথচ দীর্ঘদিন ধরে এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুধু সাময়িক সংস্কারেই সীমাবদ্ধ থাকায় ঝুঁকি থেকে যায় অপরিবর্তিতভাবে।
হলিডে কমপ্লেক্সের ভেতরে এই সেতুতে উঠতে হলে দর্শনার্থীদের পেরোতে হয় সরু সিঁড়ি। টিকিটের মূল্য মাত্র ২০ টাকা। তবে এই টাকার বিনিময়ে পাওয়া যায় না নিরাপত্তা বা নির্ভরতার নিশ্চয়তা।ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আসমা মাহমুদ বলেন, ছবিতে দেখে এত সুন্দর মনে হয়েছিল, পা?নি উঠে যাওয়ায় সেতুতে উঠেই ভয় লাগছিল। প্রতিবছর পা?নি বাড়?লেই না?কি এ সেতু ডু?বে যায়। এটি সংস্কার করা খুব জরুরি। রাঙামাটির পর্যটন কার্যক্রম মূলত বিখ্যাত ঝুলন্ত সেতুকেন্দ্রিক। অথচ বছরের একটা বড় সময় এটি পানির নিচে চলে যায়। এটি শুধু পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রশ্নই নয়, রাঙামাটির পর্যটন শিল্পের ভাবমূর্তিরও বিষয়।
১৯৮৫ সালে নির্মিত এই সেতুতে প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখের বেশি দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। জনপ্রতি ২০ টাকার টিকিট বাবদ আয় হয় ৬০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। অথচ এই অর্থের কোনো অংশও চোখে পড়ার মতো রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয় না এমন অভিযোগ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। এক পর্যটন ব্যবসায়ী বলেন, এটা শুধু একটা সেতু নয়, রাঙামাটির প্রতীক। এটাকে এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে রাখা মানে পর্যটনশিল্পকে ধ্বংস করা।
রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি বেড়ে যাওয়ায় এরইমধ্যে সেতুর পাটাতন অন্তত ৪ ইঞ্চি ডুবে গেছে। তবে একটি আধুনিক বিকল্প সেতু নির্মাণে পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরাও জানি যে সেতুটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশন থেকে যে প্রস্তাব এসেছে, সেটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। বর্তমানে আলোচনা চলছে- কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ ও পর্যটন কর্পোরেশন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে একটি আধুনিক ও টেকসই ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা যায়, সে বিষয়ে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পর্যটকদের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি পুরো এলাকার সৌন্দর্য ও আকর্ষণ বহুগুণে বাড়বে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পর্যটন কর্পোরেশনের দায়িত্বে থাকা সদস্য হাবিব আজম বলেন, সংস্কার নয়, নতুন ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের বিষয়ে এরইমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
তিনি জানান, সেতুর বর্তমান অবস্থা পর্যটকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্থায়ী সমাধানের দিকে যাচ্ছেন তারা। ‘প্রতিবছর সেতু ডুবে যায়, কাঠামোগত দুর্বলতাও রয়েছে, এই কারণে আমরা একেবারে নতুন একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিচ্ছি- যোগ করেন তিনি। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তখন শুধুই নিরাপত্তার বিষয় নয়, বরং রাঙামাটির পর্যটন ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের প্রস্তা?বে সেতুটির কাঠের বদলে টেকসই উপকরণে পুনর্নির্মাণ, বর্ষা মৌসুমে পানির উচ্চতা বিবেচনায় নতুন ডিজাইন, পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা বাজেট প্রনয়ন, সংস্কারের খরচ অনুমান করে দ্রুত প্রকল্প হাতে নেওয়া ওপর জোর দেন। রাঙামাটির পর্যটন শুধু পাহাড় আর হ্রদ দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়; এখানে রয়েছে মানুষের আবেগ ও স্মৃতি জড়ানো স্থাপনাগুলো। ঝুলন্ত সেতুটি তেমনই একটি প্রতীক। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে এই প্রতীক খুব দ্রুতই হারিয়ে যেতে পারে শুধু স্মৃতিতে।
