পাহাড়ের বুকে জলবন্দি রাঙামাটি

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মো. হান্নান, রাঙামাটি

পাহাড় ও হ্রদে ঘেরা রাঙামাটি এখন এক বিশাল জলরাশির শহর। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে জেলার বন্যা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। শুধু জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বরকল নয় কাপ্তাই হ্রদের তীরঘেঁষা অন্তত সাতটি হাটবাজার পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ক্ষতির পূর্ণচিত্র এখনও মেলেনি, তবে স্থানীয়দের দাবি এমন ভয়াবহ অবস্থা বহু বছর দেখা যায়নি।

প্রাথমিক হিসাবে, জেলার দুই পৌরসভা ও চার উপজেলার ২০ ইউনিয়নের ৮১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৫ হাজার ৭০১টি পরিবারের অন্তত ১৮ হাজার ১৪৮ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪৮টি ঘরবাড়ি, ৬১টি সড়ক, ৯৮ হেক্টর জমির ফসল, ৪৩টি মৎস্য খামার ও পুকুর এবং নয়টি হাটবাজার।

বিলাইছড়ির বাসিন্দা পাইকো মারমা জানালেন, এখন শুধু ঘরের ভেতর নয়, উঠোনেও হাঁটু সমান পানি। বাজারে যাওয়া যায় না, খাবারও শেষ হয়ে আসছে। কর্ণফুলী নদীতে প্রবল স্রোতের কারণে কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় ফেরি চলাচল টানা তৃতীয় দিনের মতো বন্ধ। এর ফলে বান্দরবান, রাঙামাটির রাজস্থলী-কাপ্তাই ও চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কাঠ ব্যবসায়ী গফুরের ভাষায়, ফেরি না চললে কাঠ আনা-নেওয়া বন্ধ। প্রতিদিন আমাদের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

বন্যার কারণে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, পরীক্ষার সময়সূচি বারবার পেছাতে হচ্ছে। বরকলের শিক্ষক শিমুল চাকমা জানান, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে, পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ডায়রিয়া ও চর্মরোগের রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হলেও অনেক দুর্গম এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছায়নি। বিলাইছড়ির জুমচাষি কবিতা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমাদের কাছে এখনও কেউ আসেনি। নৌকা ছাড়া বাইরে যাওয়া যায় না।

কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র জানিয়েছে, বর্তমানে হ্রদের পানির উচ্চতা ১০৮.৭০ ফুট মিন সি লেভেল, যা স্বাভাবিক সীমার অনেক উপরে। ১৬টি জলকপাট সাড়ে তিন ফুট খুলে প্রতি সেকেন্ডে ৬৮ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলীতে ছাড়া হচ্ছে। এতে নিম্নাঞ্চলে প্লাবন আরও বাড়ছে। এক প্রকৌশলী সতর্ক করে বলেন, যদি বর্ষণ ও উজানের ঢল না কমে, তাহলে আরও জলকপাট খুলতে হবে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও অবৈধ পাহাড় কাটার ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে গেছে, দীর্ঘ?দিন কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং না হওয়া যা বন্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাদের মতে, এ ধরনের তীব্র বন্যা আগামী দিনে আরও ঘন ঘন হতে পারে। আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা ও বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা এখন জরুরি।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ২৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় ১২টি আশ্রয়কেন্দ্রে এরইমধ্যে ৯৩৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গতদের জন্য শুকনো খাবার ও চাল বিতরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে জেলায় ৫৫৪ টন চাল মজুদ রয়েছে এবং সার্বক্ষণিকভাবে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সহায়তা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।