বন্দর নগরীতে চালু হচ্ছে তৃতীয় সিটি বাস টার্মিনাল

প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে নগরীর কুলগাঁও বালুচরা এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় সিটি বাস টার্মিনাল প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং জানুয়ারির মধ্যে অবশিষ্ট কাজ শেষ করে টার্মিনালটি চালুর প্রস্তুতি চলছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে টার্মিনালটি যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর তৃতীয় সিটি বাস টার্মিনাল চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। বালুচরায় নতুন বাস টার্মিনাল চালু হলে নগরীর বহদ্দারহাট ও কদমতলী টার্মিনালের ওপর চাপ কমবে।

রাউজান, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি উপজেলা এবং পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির যাত্রীরা সরাসরি বালুচরা থেকে বাসে ওঠানামা করতে পারবেন। এরফলে প্রতিদিন শহরে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে না। যাত্রীবাহী বড় বাস নগরে প্রবেশ না করায় অক্সিজেন, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট মোড়, কদমতলী, জিইসি, দুই নম্বর গেইটসহ নগরের প্রধান সড়কগুলোতে যানজট অনেকটাই হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের টার্মিনাল সংকট নিরসন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বর্তমানে পার্কিং সংকটের কারণে অনেক গাড়ি রাস্তায় দাঁড় করাতে হয়, এতে চুরি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। এই নতুন টার্মিনাল পরিবহন মালিক ও চালকদের জন্যও স্বস্তি বয়ে আনবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (একনেক) ২০১৮ সালে এই টার্মিনাল প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের জন্য ২৬০ কোটি টাকা, ভূমি উন্নয়নে ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, অবকাঠামো উন্নয়নে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ ইয়ার্ড নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। ৮ দশমিক ১০ একর জমিতে নির্মিতব্য এই টার্মিনালে একসঙ্গে ২০০টি বাস ও ট্রাক পার্কিংয়ের সুযোগ থাকবে। নির্মাণ কাজ শেষে চসিক টার্মিনালটি ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে রাজস্ব আয় করবে। এ বিষয়ে চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) রিফাতুল করিম জানান, টার্মিনালের ইয়ার্ড, ড্রেন ও বাউন্ডারি ওয়ালের কাজ প্রায় ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ভবনের কাজও অর্ধেক শেষ হয়েছে। জানুয়ারির মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে চালু করা সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘গত বছরের জানুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তবে ২০২৪ সালে সরকার পতনের পর টানা পাঁচণ্ডছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর পুনরায় কাজ শুরু হয়। ওই সময়ে কাজ বন্ধ না থাকলে চলতি বছরের মধ্যেই প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব হতো। চট্টগ্রামে প্রথম বাস টার্মিনাল নির্মিত হয় ১৯৬৬ সালে কদমতলীতে। এরপর ১৯৯৩ সালে বহদ্দারহাটে দ্বিতীয় টার্মিনাল চালু হয়। এরপর দীর্ঘ ৩২ বছরে আর কোনো সিটি টার্মিনাল নির্মাণ হয় নি। বর্তমানে কদমতলী ও বহদ্দারহাট টার্মিনাল ধারণক্ষমতার তুলনায় বেশি গাড়ির চাপ সামলাচ্ছে, ফলে যাত্রী ও চালকরা প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে উত্তর চট্টগ্রামের রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হয়।

বাস মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়ক দিয়ে অক্সিজেন হয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ও পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় ৫০০-৬০০টি বাস চলাচল করে। চট্টগ্রাম-নাজিরহাট-খাগড়াছড়ি বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহাজাহান জানান, উত্তর চট্টগ্রামের রুটে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক বাস চলাচল করে। কিন্তু স্থায়ী টার্মিনাল না থাকায় অনেক বাস রাস্তার পাশে দাঁড় করাতে হয়, এতে যানজট, জ্বালানি চুরি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। নতুন টার্মিনাল চালু হলে এসব সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। তিনি আরও জানান, আধুনিক এই টার্মিনালে যাত্রীদের নিরাপদ ও আরামদায়ক সেবা নিশ্চিত হলে পরিবহন খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এতে পরিবহন খাতের সুশৃঙ্খলতা ফিরবে এবং নগরীর সার্বিক যাতায়াত ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

এই টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য প্রবেশপথে তিনতলা ভবন থাকবে, যেখানে বোর্ডিং লেন, ওয়েটিং লেন, টিকিট কাউন্টার, বড় আকারের হলরুম ও লাগেজ রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি থাকছে তথ্যকেন্দ্র, ট্যাক্সি বুকিং রুম, রেস্তোরাঁ এবং নারী-পুরুষের জন্য পৃথক টয়লেট। এসি যাত্রী কক্ষ ও ওয়াই-ফাই সুবিধাও রাখা হচ্ছে। পরিবহন মালিক ও কর্মচারীদের জন্য অফিস ও আবাসন ব্যবস্থাও টার্মিনালের নকশার অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রামের প্রথম বাস টার্মিনাল কাদমতলি (১৯৬৬) এবং দ্বিতীয়টি বাহাদ্দারহাটে (১৯৯৩) নির্মিত হয়। দীর্ঘ তিন দশক ধরে নতুন কোনো শহর টার্মিনাল নির্মাণ হয় নি।

কদমতলি ও বাহাদ্দারহাট টার্মিনাল তাদের ক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। উত্তর চট্টগ্রামের রুটে টার্মিনাল সুবিধার তীব্র ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় বাস মালিকদের সংগঠন জানায়, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কে প্রতিদিন ৫০০-৬০০টি বাস চলাচল করে। নতুন বালুচর টার্মিনাল বাহাদ্দারহাট ও কাদমতলির চাপ কমাবে। রাউজান, হাটহাজারি, ফটিকছড়ি, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে যাত্রীরা সরাসরি এই টার্মিনাল থেকে বাসে ওঠাণ্ডনামা করতে পারবে। এতে শহরের যানজট ও অপেক্ষার সময় অনেক কমবে।

শহর কর্তৃপক্ষ আশা করছে, বড় বাসগুলোকে কেন্দ্রীয় রাস্তায় না নিয়ে আসার ফলে অক্সিজেন, মুরাদপুর, বাহাদ্দারহাট মোড়, কাদমতলি ও জিইসি মোড়সহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ট্রাফিক কমবে। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের পার্কিং সমস্যা কমবে, চুরি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে এবং পরিবহন মালিক ও চালকদের স্বস্তি আসবে। টার্মিনালে তিনতলা ভবন থাকবে, যাত্রী ওঠাণ্ডনামার লেন, টিকিট কাউন্টার, বড় হল এবং লাগেজ রুমের ব্যবস্থা থাকবে। তথ্যকেন্দ্র, ট্যাক্সি বুকিং রুম, রেস্টুরেন্ট এবং পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা টয়লেটও থাকবে। এয়ার কন্ডিশন্ড লাউঞ্জ ও ওয়াই-ফাই সুবিধা থাকবে। পরিবহন স্টাফদের অফিস ও আবাসনও এখানে রাখা হবে। শহরের পরিকল্পনাকারীরা মনে করছেন, টার্মিনালটি শহরের মোট ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে আরও অবকাঠামোগত প্রকল্পের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।