টেকনাফে সুপারির বাম্পার ফলন ও দামে কৃষক খুশি
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি

কক্সবাজারে টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে বিনা খরচে এ ফসলে কৃষকরা বেশি লাভবান হওয়ায় সুপারি চাষের জনপ্রিয়তাও দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া সবার মুখে মুখে প্রবাদ চালু আছে ‘টেকনাইফ্যা সুপারি-গালত দিলে মিশ্রি’।
জানা যায়, ঘূর্ণিঝড়ে সুপারি বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আশানুরূপ ফলন এবং দামও বেশি হওয়ায় সুপারি বাগান মালিকদের মুখে হাসি দেখা দিয়েছে। অন্য চাষাবাদের মতো কোনোরকম ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়ায় কৃষকরা সুপারি চাষের দিকে বেশি ঝুঁকেছেন বলে জানা গেছে। টেকনাফ উপজেলা সুপারি চাষের উপযোগী আবহাওয়া এবং মাটি হওয়ায় প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও উৎপাদিত সুপারি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হচ্ছে। কৃষি অধিদপ্তরের কারিগরি সহযোগীতা পেলে গ্রামীণ কৃষকরা সুপারি চাষ করে নিজেদের ভাগ্য বদলে আরও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে সচেতন মহলের ধারণা। উন্নত জাতের সুপারি একবার চাষ করে সারা জীবন আয়ের মুখ দেখতে পান কৃষকরা। এতে পরিবারে প্রচুর টাকা আয়ের মাধ্যমে জীবন জীবিকায় অবদান রাখে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকনাফ পৌরসভার হোটেল দ্বীপপ্লাজা ও টেকনাফ থানার সামনে দেখা যায় সুপারির বাগান মালিকরা পাকা উৎপাদিত সুপারি বিভিন্ন যানবাহনে বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে আসছেন। আবার পথিমধ্যে ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীরা সুপারি কিনে বাজারে আনছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এসে সুপারি কিনে কাদি থেকে ছিঁড়ে বস্তায় ভরে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন। টেকনাফ থানার সামনে এবং হোটেল দ্বীপপ্লাজার সামনে সাপ্তাহিক রোববার ও বৃহস্পতিবার বসে। সুপারি বাজার বসলেও প্রায় সময় দেখা যায় প্রতিনিয়ত উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে এই বাজারগুলোতে সুপারি আসে। টেকনাফ পৌরসভাসহ উপজেলার সব ইউনিয়নেই কম-বেশি সুপারি বাগান রয়েছে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়াপাড়া, তুলাতলী, উত্তর লেঙ্গুরবিল, দক্ষিণ লেঙ্গুরবিল, জাহালিয়াপাড়া, মাঠপাড়া, দরগারছড়া, রাজারছড়া, পশ্চিম গোদারবিল, নাজিরপাড়া, বড় হাবিবপাড়া, উত্তর লম্বরী, দক্ষিণ লম্বরী, মিঠাপানিরছড়া, বরইতলী, কেরুনতলী, সাবরাং ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া, ডিগিল্যারবিল, সিকদারপাড়া, মুন্ডাল ডেইল, নোয়াপাড়া, আচারবনিয়া, মগপাড়া, হারিয়াখালি, লাপারঘোনা, কচুবনিয়াপাড়া, ফতেহআলীপাড়া, কুরাবুইজ্জ্যাপাড়া, শাহপরীরদ্বীপ, হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং, উলুচামরী, রঙ্গিখালী, পানখালী, মোচনী, মরিচ্যাঘোনা, হোয়াইক্যংয়ের মরিচ্যাঘোনা, কম্বনিয়া পাড়া, খারাংখালী, নয়াবাজার, কাঞ্জরপাড়া, রইক্ষ্যং, দৈংগ্যাকাটা, লাতুরীখোলা, হরিখোলা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের পুরো এলাকায় কৃষক সুপারি চাষ করে থাকেন। উপজেলার ১টি পৌরসভা এবং ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুপারির বাগান রয়েছে সাবরাং, টেকনাফ সদর ও বাহারছড়া ইউনিয়নে। এখানকার কৃষি-অকৃষি পরিবারগুলো সহজে সুপারি চাষ করে প্রচুর টাকা আয় করছেন।
সুপারি চাষিদের দেখাদেখিতে অন্য চাষে নিয়োজিত কৃষকরাও বর্তমানে এ চাষের দিকে মনোযোগী হচ্ছেন। কেননা এ গাছ একবার রোপণ করলে প্রতি মৌসুমে ফল পাওয়া যায়। টেকনাফের আবহাওয়া ও মাটি চাষাবাদের উপযোগী হওয়ায় সার বা বিষ কোনো কিছু প্রয়োগ করতে হয় না বিধায় চাষিদের কোনো খরচ নেই বললে চলে। এদিকে টেকনাফ উপজেলা থেকে সপ্তাহের দুই হাটে ১২-১৫ ট্রাক সুপারি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। এ উপজেলার সুপারি গুণে ও মানে উৎকৃষ্ট হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কদর রয়েছে। কয়েকজন সুপারি বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুপারি চাষ একবার ভালোভাবে চাষ করতে পারলে সারাজীবন ফলন ঘরে তুলতে পারেন। বর্ষা শেষের দিকে আগাম পাকা সুপারি বাজারে বিক্রি করেন। একেকটি গাছে কমপক্ষে ৪-৫ পন (৮০টি সুপারিতে ১ পন) সুপারি ধরে। বর্তমানে আগাম পাকা এক পন সুপারি ৩৫০-৫০০ টাকারও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ লোকজনও বাড়ির খোলা জায়গায় সুপারি চাষ করে সহজেই লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। টেকনাফের উন্নয়ন বঞ্চিত কৃষি এলাকা সদর ইউনিয়ন ও সাবরাং ইউনিয়নের অধিকাংশ পরিবার সুপারি থেকে প্রচুর টাকা রোজগার করে থাকেন।
এরমধ্যে হাজার হাজার পরিবার বর্তমানে এ চাষের ওপর নির্ভরশীল। তারা অন্য চাষের চাইতে সুপারি চাষে কল্পনাতীত লাভবান হচ্ছেন। সুপারি ব্যবসায়ী ও টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুর রশিদ জানান, টেকনাফ উপজেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল হচ্ছে সুপারি। সারা দেশ জুড়ে টেকনাফের সুপারির আলাদা কদর রয়েছে। কিন্ত টেকনাফ পৌর এলাকায় নির্ধারিত কোনো সুপারি বাজার নেই। থানার সামনে, স্টেশনের হোটেল দ্বীপ প্লাজার সামনে এবং বিভিন্ন স্থানে সড়কের উভয় পাশে সুপারির বিকিকিনি চলে আসছে। সবার মুখে মুখে প্রবাদ চালু আছে ‘টেকনাইফ্যা সুপারি-গালত দিলে মিশ্রি’। অর্থাৎ টেকনাফের সুপারি ঘন চিনির মতোই সুস্বাদু। ঘন চিনিকে গ্রাম্য ভাষায় ‘মিশ্রি’ বলা হয়। আমাদের সুপারি ব্যবসায়ীদের দাবি পৌরসভা প্রশাসক নিধারিত সুপারি রাখার ব্যবস্থা করে দিলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সুপারির মালিকরা লাভবান হবে বলে মনে করি।
টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হুমায়ুন কবির বলেন, ভারী বৃষ্টির আঘাতে সুপারি বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও উৎপাদন আশানুরূপ হবে বলে আশা করছি। আমরা প্রতিনিয়ত কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছি। যে কোনোচাষে কৃষকদের কারিগরি সহায়তার ও পরামর্শের জন্য আমাদের মাঠপর্যায়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়োজিত আছেন। চলতি মৌসুমে টেকনাফ উপজেলায় প্রায় ২ হাজার হেক্টর জমিতে সুপারির চাষাবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ২২ মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক সচেতন সুপারি বাগান মালিক শুকনো মৌসুমে গাছে সার ও সেচ দিয়েছেন। এজন্য এবারে টেকনাফের সর্বত্রই সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে।
