স্ক্যানার স্থাপনের পর পতেঙ্গা টার্মিনালে বাড়ল কার্গো হ্যান্ডলিং
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

স্ক্যানার স্থাপনের পর পতেঙ্গার কনটেইনার টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং এবং জাহাজ আগমনে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। আগামী বছরের জুন নাগাদ টার্মিনালটির কার্যক্রম পূর্ণ সক্ষমতায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা একটি আমদানি স্ক্যানার— যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিদেশি অপারেটর রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয়ে গত মে মাসে এনে স্থাপন করে। এই স্ক্যানার টার্মিনালের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অন্যান্য নতুন সরঞ্জাম এখনও আনা হচ্ছে।
চলতি বছরের মে পর্যন্ত টার্মিনালটি শুধু রপ্তানি কনটেইনারই পরিচালনা করতে পারত। মে থেকে অক্টোবর- এই পাঁচ মাসে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ১ লাখ ৮ হাজার ২২৮ টিইইউএস কনটেইনার পরিচালনা করেছে; যা এর প্রথম ১৬ মাসের মোট কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান।
মাসওয়ারি কার্গো হ্যান্ডলিংও স্থিরভাবে বেড়েছে মে মাসে ১৩,৩১৪ টিইইউএস, জুনে ১৪,৫২৭ টিইইউএস এবং জুলাইয়ে ১৫,৩৯৬ টিইইউএস হ্যান্ডলিংয়ের পর আগস্টে তা অনেকটা বেড়ে ২২,৬৩৬ টিইইউএসে পৌঁছায়— যা টার্মিনালটির সর্বোচ্চ মাসিক কার্গো হ্যান্ডলিং। সেপ্টেম্বর মাসে এ কার্যক্রম কমে ১৭,৩৩৭ টিইইউএসে নামলেও, অক্টোবরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন রেকর্ড ২৫,০১৮ টিইইউএস স্পর্শ করে। সৌদি প্রতিষ্ঠান আরএসজিটিআইয়ের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুন থেকে ২২ বছরের কনসেশন চুক্তিতে পরিচালিত এই টার্মিনাল এখনও বড় ধরনের কনটেইনার দক্ষভাবে হ্যান্ডল করার জন্য আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যাতে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ বা কনটেইনারের জট কমানো যায়। এই প্রবৃদ্ধি টার্মিনালে জাহাজ আগমন বেড়ে যাওয়াও এ প্রবৃদ্ধিকে তুলে ধরে।
ফলে রপ্তানি কার্গোর প্রবাহ আরও পূর্বানুমানযোগ্য হয়ে উঠেছে। শুধু আগস্ট মাসেই সাতটি জাহাজ ভিড়েছে। আর ছয় মাসে রপ্তানি কনটেইনারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩,৩৩২ টিইইউএস, যার তুলনায় আমদানি কার্গো ৫৪,৮৯৬ টিইইউএস সামান্য বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ের প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এখনও এর নকশাগত সক্ষমতার অনেক নিচে চলছে। আগস্টের সর্বোচ্চ পর্যায়ে টার্মিনালটি মাসিক ৪১,৭০০ টিইইউএস তাত্ত্বিক সক্ষমতার মাত্র ৫৪ শতাংশই ব্যবহার করতে পেরেছে।
সেপ্টেম্বর তা নেমে আসে প্রায় ৪২ শতাংশে এবং অক্টোবর আবার ৪৯ শতাংশে পৌঁছায়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন টার্মিনালে অনেক শিপিং লাইন এখনো নিয়মিত জাহাজ শিডিউল করছে না। এ ধরনের সীমাবদ্ধতা এই প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। আরএসজিটিআই জানিয়েছে, ধীরে ধীরে কার্যক্রম বাড়ার বিষয়টি চলমান সরঞ্জাম স্থাপন ও কনসেশন চুক্তির অন্তর্ভুক্ত দুই বছরের উন্নয়ন পর্যায়েরই অংশ। এরইমধ্যে ১৪টি রাবার-টায়ার্ড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন এসে পৌঁছেছে। সেগুলো এখন কমিশনিংয়ের কাজ চলছে, আর চারটি শিপ-টু-শোর (এসটিএস) গ্যান্ট্রি ক্রেন ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে চালু হওয়ার কথা। অপারেটর বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যভাগে টার্মিনাল পুরো সক্ষমতায় পৌঁছাবে।
কার্গো হ্যান্ডলিং এখনো কেন সক্ষমতার নিচে রয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তরে আরএসজিটি চট্টগ্রামের কমার্শিয়াল ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, প্রথম নয় মাস শুধু রপ্তানি কনটেইনার হ্যান্ডল করেছি। স্ক্যানার না থাকায় আমদানি কার্গো নিতে পারিনি, তাই সংখ্যা কম ছিল। এনবিআরকে বারবার অনুরোধ করেও স্ক্যানার না পাওয়ায় আমরা নিজেদের অর্থে স্ক্যানার স্থাপন করি এবং মে মাসে আমদানি কার্যক্রম শুরু করি। এরপর থেকেই আমাদের হ্যান্ডলিং গতি পেয়েছে।
অক্টোবরে ১৪টি আরটিজি এসেছে, এর মধ্যে চারটি ইতোমধ্যে কমিশনিং সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের এপ্রিল মাসে আমরা এসটিএস গ্যান্ট্রি ক্রেন পাব এবং জুনের মধ্যে সেগুলো চালু হবে। একটি ট্রেইলারের ডেলিভারি অর্ডার নিয়ে কনটেইনার লোড করে স্ক্যানারে পৌঁছাতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে। কিন্তু স্ক্যানিংয়ের পর কাস্টমস কর্মকর্তারা ট্রেইলার ছাড়তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নেন। এতে লিড টাইম বেড়ে যায়। তিনি জানান, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বা সিপিএ-পরিচালিত টার্মিনালগুলোর তুলনায় দ্রুতগতিতে কাজ করছে, সিপিএ ঘণ্টায় ২৭ মুভস করলেও পতেঙ্গায় হচ্ছে ৪৭ মুভস। তবে যানবাহন ছাড়তে বিলম্ব হওয়ায় সামগ্রিক পারফরম্যান্সে প্রভাব পড়ছে।
তিনি আরও জানান, আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। ২০২৬ সালের জুনে ফুল অপারেশনে যেতে পারব, এই পূর্ণ সক্ষমতাকেই আমরা কাজে লাগাতে চাই। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চললে, ২০২৬ সালে আমরা সাড়ে ৪ লাখ টিইইউএস পরিচালনার প্রত্যাশা করছি। টার্মিনালটি শুরুতে এলসিএল (লেস দ্যান কনটেইনার লোড) কনটেইনার নিয়ে সমস্যায় পড়েছিল সীমিত স্টোরেজ সক্ষমতার কারণে।
আমাদের মাত্র ১০০ টিইইউএস সক্ষমতার একটি শেড ছিল, যা সম্প্রতি ৩০০ টিইইউএসে সম্প্রসারণ করেছি। কাস্টমস এজেন্ট এবং পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ফ্যাসিলিটিও যোগ করেছি। তবে আমাদের কঠোর কমপ্লায়েন্স প্রক্রিয়া নিয়ে লোকজন অভিযোগ করে। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসা করতে এসেছি, আর আমাদের ব্যবসা কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। যত বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল করব, ব্যবসাও তত বাড়বে। আগামী বছর আমরা সক্ষমতার বেশি হ্যান্ডল করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি।
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম জানান, সব সরঞ্জাম স্থাপনের পর সৌদি অপারেটর টার্মিনালকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। তারা যদি সেটা করতে পারে, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। এটি একটি আশাব্যঞ্জক প্রকল্প, তবে আগামী বছরগুলোতে এটি কেমন পারফর্ম করে তাও লক্ষণীয় বিষয়।
