ঢাকা শুক্রবার, ১৫ আগস্ট ২০২৫, ৩১ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বারাসাত বিদ্রোহ ও বীর মুজাহিদ তিতুমীর

বারাসাত বিদ্রোহ ও বীর মুজাহিদ তিতুমীর

১৭৮২ সালে কলকাতার বুকে জন্ম নেয় এক শিশু। নাম রাখা হয় সৈয়দ মীর নিসার আলী। তেতো ওষুধ দেখলে বয়স্ক ব্যক্তিরা পর্যন্ত দূরে সরে যান। কিন্তু মীর নিসার আলী সেই ছোটবেলা থেকেই তেতো ওষুধ খেতে অভ্যস্থ হয়ে পরেন। তাই তার ডাক নাম হয় তিতু। আর আসল নামের মীর যোগ হয় ‘তিতু’ শব্দটির সঙ্গে। তিনি পরিচিত হন তিতুমির নামে। মাত্র ৪ বছর বয়সে তার হাতে খড়ি শুরু হয়। তিনি একে একে শিখতে থাকেন বাংলা, উর্দু, ফারসি ও গণিত। কৈশোরে তিনি তলোয়ার বিদ্যা, তিরন্দাজি, লাঠিযুদ্ধে পারদর্শী হয়ে উঠেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআন হেফজ করেন।

১৮২২ সালে তিনি হজের উদ্দেশে মক্কাগমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি তার জীবনের আসল লক্ষ্য বুঝতে পারেন। শিরক বেদাত ছেড়ে সহিহ ইসলামে দীক্ষা নেন। তার মধ্যে বিদ্রোহের চেতনা জেগে উঠে। হয়ে ওঠেন সম্পূর্ণ ইসলামী চেতনার একজন ব্যক্তি। ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি তার মাতৃভূমি হিন্দুস্তানে আবার ফিরে আসেন।

১৮২৭ সালে তিনি ২৪ পরগণা ও নদীয়া জেলাতে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা খুব দ্রুতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। এভাবে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং এক সময় প্রায় ৪০০ জনের একটি দল তিনি গড়ে তুলতে সমর্থ হন।

তিতুমির (রহ)-এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। অপরদিকে অত্যাচারী জমিদার সন্ত্রাসীদের মাথাব্যথাও বাড়তে থাকে। হিন্দুত্ববাদী জমিদাররা তখন মুসলিমদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত। তারা মুসলিমদের দাড়ি ও মসজিদের ওপর খাজনা আরোপ করে। এমনকি কারও ইসলামী নাম রাখতে চাইলেও খাজনা দাবি করে তারা।

হিন্দুত্ববাদী জমিদারদের সঙ্গে শুরু হয় তিতুমীরের দ্বন্দ্ব। যা সংঘর্ষে রূপ নেয়। তিনি জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। এই বিদ্রোহে তিতুমীরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন মিসিকিন শাহ। তিনি তার বাহিনী নিয়ে যোগ দেন তিতু বাহিনীতে। ভারতের উত্তরে বেজে উঠে যুদ্ধের দামামা। একদিকে তিতুমীরের সাধারণ বাহিনী যারা বেশিরভাগই সেচ্ছাসেবী। আর অপর দিকে ইংরেজদের দালালি করতে করতে পেট ফুলানো জমিদাররা।

গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, নাগপুরের গৌড়ী প্রসাদ চৌধুরী, তারাকান্দির রাজনারায়ণ, গোবরডাঙ্গার কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিতুমীরের যুদ্ধ বেঁধে যায়। প্রতিটি সম্মুখ সমরেই তিতু বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় জমিদারগুলো। চারদিকে ছড়িয়ে পরে তিতুমিরের নাম। দলে দলে তার বাহিনীতে এসে যোগ দিতে থাকে মানুষ।

এরই মধ্যে তিতুমীরের খবর ব্রিটিশদের কানে পৌঁছে যায় এবং তিতুমীরকে শায়েস্তা করতে ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাঘারেয়ার নীলকুঠি প্রাঙ্গণে ১৮৩০ সালে ব্রিটিশ মিত্র হিসেবে গোবরডাঙ্গা ও নদীয়া অঞ্চলের জমিদারদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। তিন বাহিনীর সম্মিলিত শক্তিকে তুচ্ছজ্ঞান করে তাদের পরাজিত করে বীর তিতুমীর। পরবর্তী সময়ে সরফরাজপুরের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় জুম্মার নামাজের সময় মুসলিমদের ওপর হামলা করলে দু’জন ধর্মপ্রাণ মুসলিম নিহত হন। তখন তিতুমীর তার বাহিনী নিয়ে নারকেলবাড়িয়া চলে আসেন।

১৮৩১ সালের ২৭ অক্টোবর সরফরাজপুরের নারকেলবাড়িয়াতে তিতুমীর দুর্গ তৈরির চিন্তা করলেন। তার দল এখন বেশ বড়। অস্ত্রশস্ত্রের জন্য আলাদা জায়গা, মুজাহেদিনদের জন্য আলাদা জায়গা বাধ্যতামূলক হয়ে পরে। তিতুমিরের কাছে পর্যাপ্ত, অর্থ ও সম্পদ না থাকায় তিনি বাঁশ দিয়ে কেল্লা নির্মাণের নির্দেশ দেন।

সেখানেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ চলতে থাকে। তবে জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এদিকে আবার তিতুমীরের ওপর হামলার সুযোগ খুঁজতে থাকে। ২৯ অক্টোবর তিনি নারকেলবাড়িয়ায় হামলা করে বসেন এবং অতর্কিত এ হামলায় তিতুমীর বাহিনীর অনেকেই আহত হয়। এ ঘটনায় তিতুমীরের ভাগনে শেখ গোলাম মাসুম প্রায় ৫০০ জনের একটি সৈনিক দল নিয়ে তিতুমীরের সঙ্গে যোগদান করে এবং পরবর্তী সময়ে গোলাম মাসুমকে যোদ্ধা দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সেই বছর ৬ নভেম্বর জমিদার কৃষ্ণদেব ব্রিটিশদের সহায়তায় বাঁশের কেল্লা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। সঙ্গে ছিল ইংরেজ সেনাপতি ডেভিস ও প্রচুর গোলাবারুদ। কিন্তু মুজাহিদদের হামলার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে ইংরেজ ও তাদের দালালরা পালিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে দুই-তিনদিনের মধ্যে জমিদার দেবনাথ হামলা করে নারকেলবাড়িয়ায়। তিতুমীর বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে দেবনাথ পরাজিত ও নিহত হন।

বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে আরেক দফা আক্রমণ হয়, সে বছরেরই ১৩ নভেম্বর। বন্দুক নিয়েও সে যাত্রায় জিততে পারেনি ব্রিটিশ এই ম্যাজিস্ট্রেট। উভয়ের পক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও শেষতক জান নিয়ে পালিয়ে যান আলেকজান্ডার। তিতুমীরের হাতে বন্দি হয় এক দারোগা ও জমাদ্দার।

তিতুমীর হয়ে উঠে ইংরেজদের মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান। জেনারেল স্টুয়ার্ট-এর নেতৃত্বে হাজারখানেক গোলান্দায ও প্রচুর কামান নিয়ে বাঁশের কেল্লা আক্রমণের পরিকল্পনা হয়। ১৯ নভেম্বর শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ। তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ইংরেজদের ভারি ভারি কামানের গোলা সহ্য করতে পারল না তিতু বাহিনী। হঠাৎ এক কামানের গোলার আঘাতে শহীদ হন মহান মুজাহিদ তিতুমীর (রহ.)।

তথ্যসূত্র :

১. জড়ধৎ গবধফরধ

২. শত বিপ্লবীর কথা, সম্পাদনা : শেখ রফিক, পৃষ্ঠা ৩২-

৩৭, প্রকাশকাল : ২০১৪

৩. ডরশরঢ়বফরধ

৪. ংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.পড়স

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত