ঢাকা রোববার, ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

ভাষা মানুষের মনোভাব প্রকাশের মাধ্যম ও চিন্তার প্রতীক। মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে বাগ্যন্ত্রের একটি গোপন সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের মনের ভেতর হাজারো ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি, আনন্দ-বেদনা, ভয়-ভীতি, মায়া-মমতা, জানার কৌতূহল, যোগ্যতা প্রদর্শন ইত্যাদির জন্য ভাষার প্রয়োজন। এককথায় মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন পূরণের জন্যই ভাষার সৃষ্টি। ভাষা ছাড়া মানব সভ্যতা অচল। মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নিয়ামতগুলোর মধ্যে ভাষা অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তার নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো আসমান-জমিন সৃষ্টি, তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা, নিশ্চয় এর মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে। (সুরা আর-রুম : ২২)।

মায়ের কাছ থেকে পাওয়া মায়ের মুখের ভাষাকেই আমরা মাতৃভাষা বলে থাকি। পৃথিবীর যেকোনো ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ সবচাইতে বেশি। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ভাষার শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পরে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আর তিনি আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন, তারপর সমুদয় ফেরেশতার সম্মুখে প্রকাশ করলেন। অতঃপর বললেন, এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সুরা বাকারা-৩১)। ওই আয়াতে বর্ণিত ‘এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও’-এর ব্যাখ্যায় আল্লামা মাহমুদ আলুসী (রহ.) বলেন, এর দ্বারা পৃথিবীর সব ভাষাকে বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালা হজরত আদম (আ.)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (তাফসিরে রুহুল মা’আনী- খ:১, পৃ:-২৬১)। প্রিয় নবীজি (সা.) মায়ের ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসতেন। তিনি বলেছেন, আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত। (আল মু’জাম, ইবনুল আরাবি-২৩৪৫)।

একটি শিশু পৃথিবীতে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বাভাবিক বিকাশ হতে থাকে। এই শৈশবেই সে তার মা-বাবার কাছ থেকে ভাষা শেখে। সুতরাং মাতৃভাষা হলো সেই ভাষা, যা তার মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রে লাভ করেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে মাতৃভাষা হলো অন্তরের ভাষা, ব্যক্তির মনন ও চেতনার ভাষা। মায়ের মুখ থেকে শোনা প্রচলিত শব্দভান্ডার যখন শিশুর মনের ভাব প্রকাশের সহজতর মাধ্যম হয় শিশুর জন্য, ওই ভাষাকেই বলা হয় মাতৃভাষা। মানুষের জন্মগত যেসব অধিকার রয়েছে, মাতৃভাষার অধিকার তার মধ্যে অন্যতম। কেননা, নিজের ভাষায় মানুষ কথা বলে প্রয়োজন মেটায়, স্বাধীন মত প্রকাশ করে থাকে। মাতৃভাষাকে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার নামান্তর।

যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৎপথ দেখানোর জন্য অনেক নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। ওই নবী-রাসুলরা যে এলাকায় প্রেরিত হয়েছিলেন তাদের সবার ভাষাই ছিল তাদের স্বজাতির ভাষা। তারা সবাই মাতৃভাষায় আপন আপন দ্বীন প্রচারের কাজ চালিয়েছেন এবং তাদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবগুলোর ভাষা ছিল ওই জাতিরই ভাষায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি। তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। অতঃপর আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান পথ দেখান, যিনি মহাসম্মানিত, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইব্রাহিম-৪)।

হজরত মুসা (আ.) স্পষ্ট উচ্চারণের নিমিত্তে আল্লাহর কাছে সামর্থ্য প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা তোয়া-হা : ২৭-২৮)। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বড় চারটি আসমানি কিতাব তাদের স্বজাতির ভাষাতেই অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ, ‘তাওরাত’ কিতাব হিব্রু ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘যাবুর’ ইউনানি ভাষায়, হজরত ইসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘ইঞ্জিল’ সুরিয়ানি ভাষায় এবং সর্বশেষ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ কিতাব ‘আল-কোরআন’ আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি সেটাকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তোমরা বুঝতে পার (সুরা ইউসুফ-০২)। আসমানি কিতাবগুলোকে যদি আল্লাহ তায়ালা মাতৃভাষায় নাজিল না করতেন তাহলে ওই নবীর উম্মতরা সহজে বুঝতে পারত না। আল্লাহ তায়ালা তাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাবকে তাদের ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর যদি আমি কোরআন অনারবদের ভাষায় নাজিল করতাম তবে তারা অবশ্যই বলতÑ এর আয়াতগুলো বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়নি কেন? এ কেমন কথা, অনারবি কিতাব এবং আরবিভাষী রাসুল! আপনি বলুন এ কোরআন মোমিনদের জন্য হেদায়েত ও ব্যধির প্রতিকারস্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না, তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা এবং কোরআন তাদের জন্য অন্ধত্বস্বরূপ। (সুরা হা-মিম আস সিজদাহ-৪৪)।

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় আটত্রিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা একটি সমৃদ্ধশালী ভাষা। বিভিন্ন সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও ভাষাবিজ্ঞানীর হাজার বছর চর্চার মাধ্যমে এটি বর্তমানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ভাষা হিসেবে স্থান লাভ করেছে। আজ আমাদের চেতনা হওয়া প্রয়োজন জাতীয় জীবনে সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বাংলা ভাষাকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান। একটা ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে, বাংলা ভাষা শিখলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখা যাবে না। তাই অনেকেই বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে থাকে। ফলে নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণকে আজ বাংলা সনের কোন মাস? কোন তারিখ? জিজ্ঞাসা করলে সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খ্রিষ্টীয় সাল ব্যবহার করা যেমন প্রয়োজন, নিজস্ব স্বকীয়তা ও বাঙালি জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে বাংলা সনের ব্যবহারও কম প্রয়োজন নয়। সুতরাং আজকের প্রত্যাশা হলো, তরুণরা সময়ের প্রয়োজনে অন্য ভাষা শিখলেও শিখুক; কিন্তু মাতৃভাষা হিসেবে আমার মায়ের ভাষাকে মর্যাদার আসনে স্থান দিক, চর্চা করুক বাংলাভাষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আরও সমৃদ্ধ হোক আমাদেরই বাংলা ভাষা।

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত